ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনা বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে ভারতের টেলিকম ডিপার্টমেন্ট রাষ্ট্রীয় একাধিক টেলিকম কোম্পানিতে চীনভিত্তিক হুয়াওয়ে ও জিটিইর নেটওয়ার্ক গিয়ার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ভাবছে। পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের বৃহৎ দুই টেলিকম কোম্পানি ভারতী এয়ারটেল ও ভোডাফোন আইডিয়া লিমিটেডকে প্রতিষ্ঠান দুটির নেটওয়ার্ক গিয়ার বর্জনে বাধ্য করতে পারে। খবর ইটি টেলিকম।
ভারত সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সীমান্ত উত্তেজনার জেরে হুয়াওয়ে ও জিটিইকে নিষিদ্ধের মাধ্যমে চীনের বিরুদ্ধে প্রথম বড় ধরনের কোনো অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ভারত সরকার।
শুধু তা-ই নয়; চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনার প্রভাব পড়তে যাচ্ছে ভারতের ফোরজি নেটওয়ার্ক সেবা খাতে। রাষ্ট্রীয় টেলিকম কোম্পানি ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (বিএসএনএল) এবং মহানগর টেলিফোন নিগম লিমিটেডের (এমটিএনএল) সঙ্গে ফোরজি উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম সরবরাহের চুক্তি রয়েছে চীনা দুই প্রতিষ্ঠানের, যা বাতিল করা হতে পারে। বাস্তবে এমন হলে ভারতীয় টেলিকম কোম্পানিগুলোর জন্য ফোরজি উন্নয়ন ও বিস্তারে কোনো ধরনের নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারবে না হুয়াওয়ে ও জিটিই। শিগগিরই এ নিয়ে ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সরকারি সূত্রমতে, সীমান্তে ভারত ও চীনের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তারই প্রতিক্রিয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যে কারণে বিএসএনএলের পক্ষ থেকে ফোরজি সেবার উন্নতিতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের জন্য নতুন করে টেন্ডার ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শুধু সরকারি টেলিকম কোম্পানিই নয়, ব্যক্তি খাতের টেলিকম কোম্পানিগুলোকেও চীনা সরঞ্জাম বর্জনের নির্দেশনা দেয়া হলে নতুন করে ভেন্ডর বাছাই করতে হবে। এক্ষেত্রে ভারতের টেলিকম খাতে ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হবে নকিয়া ও এরিকসনের।
ভারতী এয়ারটেল ও ভোডাফোন আইডিয়ার মতো টেলিকম কোম্পানিগুলো তাদের বর্তমান নেটওয়ার্ক অবকাঠামো পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনায় হুয়াওয়ের সঙ্গে কাজ করে। অন্যদিকে জিটিই কাজ করে রাষ্ট্রীয় টেলিকম কোম্পানি বিএসএনএলের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনায়।
টেলিযোগাযোগ খাতের বৃহত্তম বাজার ভারত। বিশ্বজুড়ে চীনা টেলিকম গিয়ার নির্মাতাদের পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও দেশটিতে ফাইভজি ট্রায়ালে অংশগ্রহণের অনুমতি পেয়েছিল হুয়াওয়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও এর কয়েকটি মিত্র দেশের চাপে চীনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির ফাইভজি প্রযুক্তি নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও ভারত সরকারের হুয়াওয়েকে ফাইভজি ট্রায়ালে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়াকে উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় ভালো সম্পর্কের নিদর্শন বলে মনে করা হচ্ছিল। সীমান্ত উত্তেজনার জেরে ভারতে ফাইভজি প্রকল্প থেকেও নিষিদ্ধ হতে পারে চীনা প্রতিষ্ঠান দুটি।
হুয়াওয়ে বিশ্বের বৃহৎ টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম এবং দ্বিতীয় বৃহৎ স্মার্টফোন নির্মাতাই নয়; পঞ্চম প্রজন্মের আল্ট্রা-হাই-স্পিড মোবাইল নেটওয়ার্ক ফাইভজি অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রযুক্তি উন্নয়নেও নেতৃত্ব দিচ্ছে। ফাইভজি অবকাঠামো নির্মাণ ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের শুরুতে নকিয়া ও এরিকসনের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য বিরোধের জেরে হুয়াওয়ের নেটওয়ার্ক সরঞ্জামের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। হুয়াওয়ে তাদের টেলিকম সরঞ্জামের মাধ্যমে মার্কিন নাগরিকদের তথ্য চীন সরকারের কাছে পাচার করার অভিযোগ তোলা হয়েছে। এমন অভিযোগে গত বছরের শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠানটির ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন বিচার বিভাগ। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য বিরোধের শিকার হুয়াওয়ে বিষয়ে কিছুটা দেরিতে হলেও নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছিল ভারত। এর আগে মালয়েশিয়া, রাশিয়া ও ইতালির কাছ থেকেও ফাইভজি প্রযুক্তি নিয়ে ইতিবাচক সাড়া পায় হুয়াওয়ে। তবে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স ও জাপানসহ অনেক দেশেই ফাইভজি প্রকল্প থেকে বাদ পড়েছে হুয়াওয়ে।
গত জানুয়ারিতে হুয়াওয়ে জানায়, ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত দেশটিতে পঞ্চম প্রজন্মের দ্রুতগতির টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি স্থাপনে তাদের প্রত্যাশাকে বহু গুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
ওই সময় দেশটির টেলিকমমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, সব নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম ভেন্ডর ও সেলফোন অপারেটরদের সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি চালুর কাজ চলছে। গত মার্চে ভারতে ফাইভজির তরঙ্গ নিলাম অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যা স্থগিত হয়ে যায়।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য বিরোধের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে হুয়াওয়ে। নেটওয়ার্ক সরঞ্জামের নিরাপত্তা দুর্বলতা এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইরানে পণ্য সরবরাহের অভিযোগে হুয়াওয়ের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে হুয়াওয়ের ব্যবসা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি হুয়াওয়ে ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের হুমকি-ধমকির পর সুর বদল করেছে মার্কিন বাণিজ্য বিভাগ। এখন তারা চীনভিত্তিক হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সংশোধন করবে বলে জানিয়েছে। ফলে পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি ফাইভজি নিয়ে হুয়াওয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো।