মাত্র আটজন মানুষ মহাসাগরের সবচেয়ে গভীরতম স্থান চ্যালেঞ্জার ডিপ-এ পৌঁছতে পেরেছেন। আর মহাকাশ ঘুরে এসেছেন অন্তত ৫৫০ জন। কিন্তু দুটি গৌরবই রয়েছে মাত্র একজন মানুষের, ক্যাথি সুলিভান।
গত রোববার পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে ১০ হাজার ৯২৮ মিটার (৩৫ হাজার ৮৩৫ ফুট) গভীর চ্যালেঞ্জার ডিপে পৌঁছেছেন নাসার নভোচারী ও সমুদ্রবিজ্ঞানী ক্যাথি। অ্যাডভেঞ্চার কোম্পানি আইয়োস ও সাগরতলের প্রযুক্তি স্পেশালিস্ট প্রতিষ্ঠান ক্যালাদান ওশানিকের যৌথ আয়োজন ‘রিং অব ফায়ার’ অভিযান পরিচালিত হয়।
মারিয়ানা ট্রেঞ্চে অবস্থিত চ্যালেঞ্জার ডিপে এই অভিযান সামনে রেখে তিনজন নির্ভীক অভিযাত্রীকে আমন্ত্রণ জানায় আইয়োস, যাকে তারা বলছেন ‘মিশন স্পেশালিস্টস’। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের কাছাকাছি ভূমি হলো গুয়াম দ্বীপ।
তিনজনের মধ্যে প্রথমে সুলিভানই ১০ ঘণ্টার এই দীর্ঘ ও শ্বসরুদ্ধকর অভিযানে মহাসাগরের সবচেয়ে গভীরে পৌঁছেন। বাকি দুজনের চলতি সপ্তাহেই তাকে অনুসরণ করে সেখানে পৌঁছানোর কথা।
সিএনএনকে সুলিভান বলেন, ‘আমি জানি চার্টে এটি (চ্যালেঞ্জার ডিপ) ব্যাথিমেট্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, গঠনে বিশিষ্ট আর ভূমিকম্প প্রবণও। কিন্তু এসব সব তথ্য আসলে বোধশক্তির ব্যাপার। আমার মনে হয়, কোনো সমুদ্র বিজ্ঞানীই এমন আমন্ত্রণকে পায়ে ঠেলে দিতে পারবেন না।’
১১ দশমিক ৫ টন ওজনের ‘লিমিটিং ফ্যাক্টর’ (সনদপ্রাপ্ত বিশ্বের একমাত্র যান যা কিনা বারংবার মহাসাগরের যেকোনো গভীরে ডুব দিতে সক্ষম) নামের বিশেষ সমুদ্রযানে চড়ে ডুব দেয়ার আগে তিন অভিযাত্রীকেই মিশন সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়ে দেয়া হয়েছে, বলা হয়েছে এর বিস্তারিত সূচি সম্পর্কে এবং গবেষণার ধরণও বলে দেয়া হয়েছে। তবে শারীরিক অনুশীলনের ব্যাপারে আইয়োস এক্সপিডিশন এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও রিং অব ফায়ার এক্সপিডিশন এর নেতা রব ম্যাককালাম বলেছেন, এটা আসলে এভারেস্ট পর্বতে আরোহন কিংবা মহাকাশে অভিযানের মতো নয়। তার কথায়, ‘তিনজন মানুষই দুঃসাহসিক, কিন্তু এতে অংশগ্রহণের জন্য আপনাকে অ্যাথলিট হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা খানিকটা নতুন কিছু, কিন্তু অবশ্যই ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
অভিযাত্রীরা মহাসাগরের তলে যাওয়ার আগে সেখানকার পানির তাপমাত্রা, লবনাক্ততাসহ নানা অবস্থা জানতে বৈজ্ঞানিক যান ‘ল্যান্ডার্স’ পাঠানো হয়। এই যানটি সঠিক জায়গায় পৌঁছানোর পর অভিযাত্রীরা নিমজ্জমান যানে অভিযান শুরু করেন।
আজীবনের এক অভিযাত্রী সুলিভান
ছোট্ট কিশোরী থাকাকালেই অভিযাত্রীদের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহ অনুভব করতেন সুলিভান। তার কথায়, ‘আমি সব সময়ই শুরুর দিকের মহাকাশ অভিযাত্রী ও মহাসাগর অভিযাত্রীদের ব্যাপারে খোঁজ রাখতাম, যেমন জ্যাকস কুস্তিউ। তারা সবাই ছিলেন খুবই কৌতুহলী মানুষ। তারা সবাই ছিলেন খুবই সুচতুরও যারা জানতেন কীভাবে কঠিন কোনো কাজ সম্পন্ন করা যায়। ওইসব অনুসন্ধিৎসা, দুঃসাহসিক কাজের অনুভুতি আর কৌতুহল আমাকে অভিযানের পথে টেনে এনেছে। আমি নিজের মধ্যে সেই অনুরণন দেখি যা দেখেছি তাদের মধ্যেও।’
যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন সুলিভান সান্তা ক্রুজে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার কলেজে পড়ার সময় মারিয়ানা ট্রেঞ্চ ও চ্যালেঞ্জার ডিপ সম্পর্কে জানতে পারেন। প্রথমে রাশিয়ার বিষয় সম্পর্কে পড়াশোনা করতে চাইলে পরে কিছু বিজ্ঞান ক্লাস (যদিও মনের বিরুদ্ধে) তার জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়। এ নিয়ে সুলিভান বলেন, ‘হঠাৎই অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, অভিযানের অনেক গল্প আসতে লাগল এবং মহাসাগরের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, স্রোত ও নানা দিক সম্পর্কেও জানতে পারলাম। এসব আমাকে মুগ্ধ করল।’
মহাসাগরে মোহিত হয়ে সুলিভান এ বিষয়ে পড়তে লাগলেন ডালহৌসি ইউনিভার্সিটিতে, যেখানে তিনি ভূতত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রীও নেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল উত্তর আটলান্টিক। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘পড়াশোনার মাঝেই আমি বুঝতে পারি, অভিযানের পরিকল্পনা, নকশা তৈরি কিংবা অভিযানে নামা আমার ভালো লাগে।’
যখন নাসার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখলেন তখন ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং নাম লেখালেন অভিযাত্রীর তালিকায়। ১৯৭৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন করার পরই নাসায় যোগ দেন এবং ১৯৮৪ সালে স্পেস শাটল চ্যালেঞ্জারের অংশ হয়ে প্রথম আমেরিকান নারী হিসেবে মহাকাশে পৌঁছে ইতিহাস গড়েন। নাসা ক্যারিয়ারে এরপর আরো দুটি মিশনে নাম লেখান সুলিভান। ১৯৯০ সালে স্পেস শাটল ডিসকভারিতে এবং ১৯৯২ সালে স্পেস শাটল আটলান্টিসেও অন্যতম অভিযাত্রী হিসেবে ছিলেন তিনি।
পরে তিনি ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন এবং এভাবেই তার মহাসাগরের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। সুলিভান নিজেকে নিয়ে বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম প্রথম নারী হিসেবে এমন একজন চ্যালেঞ্জার ডিপ মিশনে নামুক যে সত্যিকার অর্থে সুযোগটা কাজে লাগাতে পারবে। ক্যাথির রয়েছে অনবদ্য ট্র্যাক রেকর্ড। তিনি অষ্টম মানব হিসেবে এ কাজটি করছে -এটা দুর্দান্ত এক অভিযান।’