ভূমধ্যসাগর অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে উচ্চবিলাসী তুরস্ক

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার উচ্চবিলাস থেকে সরে এসেছে ইউরোশিয়ার দেশ তুরস্ক। এখন ভূমধ্যসাগর নিয়ন্ত্রণের উচ্চবিলাস ভর করেছে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ানের উপর। ফলে ন্যাটো জোট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পলিসিকে আর তোয়াক্কা করছে না তুরস্ক। সিরিয়া ও লিবিয়ায় পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে লড়ছে তুর্কি সেনারা। সর্বশেষ এক সময়ের গীর্জা আস সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করে পশ্চিমাদের চোখে একজন ‘কট্টরপন্থি’ হিসাবে চিত্রায়িত হলেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ।

ফলে লিবিয়া ও সিরিয়া সংকটে বড় অংশীদার তুরস্ককে ঘিরে পশ্চিমা ও আরব রাষ্ট্রের একনায়কতান্ত্রিক শাসকদের নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়ছে। আরব-পশ্চিমা বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ানো রাজনৈতিক ইসলামকে ভালভাবে দমানো গেছে। গণতন্ত্রের চবক দেওয়া পশ্চিমারা মুরসিকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসা জেনারেল সিসিকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়েছে। কিন্তু এরদোয়ান সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সেনা অভূত্থানের পর তুরস্কের সাথে পশ্চিমাদের বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। এই ব্যর্থ সেনা অভুত্থানের পেছনে পশ্চিমাদের হাত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সব ছাড়িয়ে ভূমধ্যসাগর অঞ্চল ও বসফরাস প্রণালি নিয়ন্ত্রণে তুরস্কের সামরিক পরিকল্পনা পশ্চিমা ও আরব শাসকদের উদ্বিগ্ন করছে।

ভূমধ্যসাগরে অতি সম্প্রতি তুরস্কের তেল অনুসন্ধানী জাহাজ গ্রিসের সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছে গ্রিস সরকার। এই ইস্যুতে গ্রিসের পক্ষ নিয়ে ফ্রান্স তুরস্কের উপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে। তবে ভূমধ্যসাগরের মূল সংকট শুরু লিবিয়াকে ঘিরে। রক্তাক্ত ও বিভক্ত লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের অন্যতম সমর্থক তুরস্ক। এই সরকারের বিদ্রোহী গ্রুপ জেনারেল হাফতাবকে সমর্থন করছে ফ্রান্স, মিসর, রাশিয়া ও আরব আমিরাত। সংকট আরও জোরালো হয় যখন অস্থিতিশীল লিবিয়ার জাতীয় সরকারের সাথে তুরস্ক সরকার চুক্তি সম্পদান করে। ২০১৯ সালে স্বাক্ষরিত সে চুক্তিটি ছিল সামরিক সহযোগিতা ও সমুদ্র প্রতিরক্ষা বিষয়ক। এই চুক্তির ফলে লিবিয়ার সমুদ্র উপকূলে তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান এবং নিরাপত্তা দিতে পারবে তুরস্ক। এছাড়া লিবিয়া সরকার অনুরোধ করলে লিবিয়ায় সামরিক সৈন্যও পাঠাতে পারবে তুরস্ক। চুক্তির পর দুই দেশ তুরস্কের সমুদ্র উপকূল থেকে লিবিয়ার সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত একটি ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ তৈরির ঘোষণা দেয়। এই অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণায় গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাস (সাইপ্রাসের অন্য একটি তুর্কি সাইপ্রাস নামে পরিচিত যা তুরস্ক সমর্থিত সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত) তাদের সমুদ্রসীমায় লঙ্ঘন হয়েছে অভিযোগ করে। সেই অভিযোগকে আমলে না নেওয়া তুরস্ককের ভূমধ্যসাগরের উচ্চবিলাসের লাগাম টেনে ধরতে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে তুরস্কবিরোধী একটি জোট গঠন করেছে মিসর, ফ্রান্স, আরব আমিরাত, গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাস। যদিওবা এই জোটের পেছনে অপ্রকাশ্যে রয়েছে সৌদি আরব ও ইসরাইল।

পশ্চিমাদের আশঙ্কা ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ব্যাপক আকারে তুরস্কের উপস্থিতি ভূমধ্যসাগরের পূর্বপার থেকে ইউরোপ অভিমুখের তেল-গ্যাসের চালানকে ঝুঁকিতে ফেলবে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুযায়ী ভূমধ্যসাগরে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের তেল ও ৫ ট্রিলিয়ন কিউবেক গ্যাস মজুদ রয়েছে। যার বড় একটি অংশ গ্রিস ও সাইপ্রাসকে ঘিরে। সাইপ্রাসের যে অংশ তুর্কি সাইপ্রাস নামে নিজেদের স্বাধীনতা দাবি করছে তাদের একমাত্র স্বীকৃতিদাতা দেশ তুরস্ক। তুর্কি সাইপ্রাস নিয়ে সামরিক পরিকল্পনা রয়েছে তুরস্কের।

সম্প্রতি তুরস্ক সরকার ভূমধ্যসাগরের দেশ লিবিয়ায় বৃহৎকারে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। ত্রিপোলি বর্তমানে তুর্কি সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে ১৯৪০ সালে নির্মিত আল ওয়াতিয়া বেস সামরিক ঘাঁটি দখল নিয়েছে তুর্কি সৈন্যরা। বিদ্রোহী জেনারেল হাফতাব পালিয়েছেন মিসরে। তুরস্কের বিরুদ্ধে থাকা দেশগুলোর সাথে আঙ্কারার কূটনৈতিক সম্পর্ক নানা কারণে পূর্ব থেকেই শীতিল। মিসরের সিসি সরকারকে এখনো স্বীকৃতি দেয়নি এরদোয়ান সরকার। জেনারেল সিসিও লিবিয়ায় তুরস্কের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপে মিসরের সংসদের অনুমোদন নিয়ে নিয়েছে।

এই সামরিক উত্তেজনা মধ্যে লিবিয়ায় মুখোমুখি অবস্থানের থাকা দুই দেশ তুরস্ক ও রাশিয়া গৃহযুদ্ধ প্রতিরোধ ও যুদ্ধ বিরতি বাস্তবায়নে একমত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জেনারেল হাফতাবকে সমর্থনকারী আন্তজার্তিক গ্রুপের অন্যতম দেশ রাশিয়া তুরস্কের সাথে একসাথে কাজ করার ঘোষণা বিরোধীজোটকে দুর্বল করে দিবে। এখন তুরস্কের বিরুদ্ধে লিবিয়া-ভূমধ্যসাগর এলাকায় লড়তে হবে ফ্রান্স-মিসর-আমিরাতকে। ফ্রান্স তুরস্কের বিরুদ্ধে ন্যাটো জোট বা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ব্যবহার করতে চাইলেই তার বাস্তবতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ফ্রান্স যখন ভূমধ্যসাগরের তাদের রণতরীকে লক্ষ্য করে তুরস্ক অস্ত্র তাক করছে বলে অভিযোগ করছে তখন জার্মানির চ্যান্সেলর ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট একে অপরের খোঁজ নিতে ফোন করেছেন। এছাড়া অভিবাসী ঢল নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাস দমন, ইরান ও রাশিয়ার বাণিজ্য দমনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে তুরস্কের বন্ধুত্বে না বলার সুযোগ নেই। লিবিয়া ইস্যুতে রাশিয়া ও তুরস্কের ঐক্যমত তৈরীর চেষ্টা এই অঞ্চলে আরও নানা ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। ন্যাটো জোটের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকার আপত্তি উপেক্ষা করে রাশিয়া থেক এস-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে তুরস্ক। রাশিয়াও হাসিমুখে সামরিক অংশীদার হয়েছে তুরস্কের। লিবিয়ার পাশাপাশি সিরিয়ায়ও রাশিয়া ও তুরস্ক মুখোমুখি। সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারের বড় সমর্থক রাশিয়া অন্যদিকে বিদ্রোহী সরকারের পৃষ্ঠপোষক তুরস্ক সরকার। এছাড়া কৃষ্ণসাগর ও ক্যাস্পিয়ান সাগর অঞ্চলের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ আজারবাইজানের ঘনিষ্ট মিত্র তুরস্ক অন্যদিকে আর্মেনিয়ার সাথে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয় রাশিয়া। ফলে দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর কৌশলগত ঐক্যমত পৌঁছানোর ফলে এই অঞ্চলে পশ্চিমা প্রভাব ক্ষীণ হয়ে উঠবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প সিরিয়া ও লিবিয়া ইস্যুতে তুরস্কের সমর্থক থাকলেও লিবিয়ায় বর্তমানে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করছে। তুরস্ক ও মিসরের সামরিক উত্তেজনার সময় মি. ট্রাম্প এরদোয়ান ও জেনারেল সিসিকে ফোন করেন। রাশিয়া একটি কৌশলগত অবস্থান নেওয়ার ফলে হোয়াইট হাউজ মিসর তুরস্কের মধ্যে একটি মধ্যস্থতার চেষ্টা করবে। তবে যদি লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ যদি তুরস্কের হাতে যায় তা হবে ইসরাইল, মিসরের ভূরাজনৈতিক পরাজয়।

জ্বালানি নিরাপত্তার ছাড়া তুরস্ককে নিয়ে পশ্চিমাদের মাথাব্যথার আরও অনেক কারণ আছে। লুজান চুক্তি অনুসারে বসফরাস প্রণালী আন্তর্জাতিকরণ হয়। কিন্তু ২০২৩ সালে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষে এরদোয়ান সে চুক্তির মেয়াদ না বাড়িয়ে বসফরাস প্রণালীতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণ সাগরের মধ্যে জাহাজ চলাচলে শুল্ক আরোপ করতে পারে তুরস্ক। পশ্চিমা ও আরব শাসকদের কাছে এটা স্পষ্ট রাশিয়ার পুতিন যেমন নব্য সোভিয়েতিজম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে তুরস্কের এরদোয়ানও নতুন একটি অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চান। সৌদিদের উপর ফিলিস্তিনের অবিশ্বাস তৈরি হওয়ার পর তাদের অভিভাবক হওয়ার চেষ্টা করছে তুরস্ক। কাতার, পাকিস্তান ও ইরানের সাথে কৌশলগত জোট করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। সে লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকতে চান এরদোয়ান। আস সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তুর্কি জাতীয়তাবাদী ও কট্টর ইসলামপন্থিদের মন জয় করেছেন। যদিওবা আঘাত দিয়েছেন দেশের সেক্যুলার জনগণ ও পশ্চিমা বিশ্বকে। যেভাবেই হোক নিজ দেশে অবস্থান পাকাপোক্ত হলে এরদোয়ান নির্বাচনের ঘোষণা দিতে পারেন। তার লক্ষ্য ২০২৩ সাল ছাড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা। আফ্রিকা,এশিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণ সাগর হয়ে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব তৈরি করা। তবে কভিড-১৯ এর পরবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্বে প্রতিদিন ভূ-রাজনৈতিক চমক তৈরি করছে। কোনদেশ সামরিকভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে কেউ আবার নতুন সামরিক পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছে। ফলে উচ্চবিলাসী এরদোয়ানের উচ্চবিলাস কোথায় গিয়ে ঠেকে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *