বাম্পার ফলনেও খরচ উঠছে না বোরো চাষিদের

ডেস্ক রিপোর্ট : ঝালকাঠি জেলার ৪ উপজেলায় কৃষি অধিদফতরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৭৫ হেক্টর অতিরিক্ত জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। চাষিদের বোরো আবাদে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকের মুখে হাসির পরিবর্তে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা। ধানের দাম কম থাকায় এলাকার হাজার হাজার কৃষকের চোখে মুখে হতাশার ছাপ দেখা দিয়েছে।

তাদের মুখে আর হাসি নেই। এলাকার অসহায় দরিদ্র কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এবার সারা দেশের মতো ঝালকাঠি বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এই বাম্পার ফলনই কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার, বীজ, কীটনাশক, আগাছা দমন, মাড়াইসহ প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রয় দাম কম হওয়াতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কৃষকরা। সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করে কৃষক ফসল ফলান; কিন্তু কৃষক তার ন্যায্য দাম পান না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কৃষি বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এ বছর ২৭৫ হেক্টরে আবাস সম্প্রসারণ বেশি হয়েছে। এছাড়া বোরো চাষাবাদকালীন ধানক্ষেতে কোনো ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি। উচ্চ ফলনশীল জাত থেকে হেক্টর প্রতি ৫-৬ মেট্রিক টন এবং সুপার হাইব্রিড থেকে ১০-১২ মেট্রিন টন ধানের ফলন পাওয়া গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, ঝালকাঠি জেলায় ৯,৫৭৫ হেক্টরে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ৯,৮৫০ হেক্টরে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড জাতের মধ্যে সুপার হাইব্রিড এস এল-৮ জাত এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের মধ্যে ব্রি-২৮-২৯, ব্রি-৪৭ বিনা-১০ সিংহ ভাগ চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৯,৫৫০ হেক্টরে উচ্চ ফলনশীল এবং ২৯০ হেক্টরে হাইব্রিড ও ১০ হেক্টরে স্থানীয় জাতের আবাদ হয়েছে। তবে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও ধানের ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না।

জানা গেছে, প্রতি বছর স্থানীয় একশ্রেণির অসাধু, অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও দালালচক্র কৃষকদের এই অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে ধানের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর পরিবেশ অনুকূলে থাকায় সাধারণ কৃষকরা ধান চাষ করে একটু লাভের আশা করেছিলেন; কিন্তু ধান কাটা শুরু হতেই তারা আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলছেন।

ধানের দরপতনের ফলে প্রান্তিক ও বর্গাচাষিরা পড়েছেন মহাবিপদে। ধান চাষের আগে এলাকার অধিকাংশ কৃষক চড়া সুদে এনজিও, ব্যাংক ও মহাজনদের কাছ থেকে সুদে টাকা ঋণ নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। চলতি মৌসুমে ধান কাটার শুরুতেই ঋণের টাকার চাপ, শ্রমিকের মজুরি পরিশোধের চাপে বোরো ধান ক্ষেত থেকেই পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা।

করোনাভাইরাসের কারণে শ্রমিকসঙ্কটের কারণে অনেকেই ধান কাটতে পারছেন না। একজন শ্রমিককে প্রতিদিন তিনবেলা খাবারসহ সাড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা মজুরি দিতে হয়। কৃষকের শুধু ধান কাটতেই খরচ হয় প্রায় ৮০০ টাকা। অন্যান্য খরচ তো আছেই। ফলে ধানের দাম কম থাকায় ধান বিক্রি করে তাদের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না কৃষকরা।

তার ওপর ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচসহ সংসারের যাবতীয় খরচ চালাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। উপজেলার রমনাথপুর গ্রামের মুন্নাফ মিয়া, ঠান্ডু, নজু মোল্লাসহ অনেক কৃষক জানান, প্রতি বিঘায় ২৫-৩০ মণ ধান পেয়েছেন; কিন্তু ধানের দাম না থাকায় আসল টাকা ওঠা তো দূরের কথা, এবার অনেক টাকা লোকসান হবে।

কৃষক কবির খান জানান, ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তিনি প্রায় দুই বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। কীটনাশক, সেচ, হাল দেয়া, আগাছা দমন, ধান মাড়াই ও কাটাসহ প্রতি মণ ধানে প্রায় ৬০০ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রতি মণ বোরো ধান ঘিওর হাটে বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায়। কাজেই এবার ধানে আদৌ কোন লাভ হবে না।

গ্রামের কৃষক সাকাওয়াত জানান, চার বিঘা জমি লিজ নিয়ে বোরো আবাদ করেছি। প্রতিমণ ধান উৎপাদন করতে আমার খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬০০ টাকা। বাজারে ধান বিক্রি হচ্ছে মাত্র সাড়ে ৫০০ টাকা।

ধান কাটা শ্রমিক বকুল, শাজাহান, রফিক জানান, প্রতিদিন ৬০০ টাকা রোজ হিসাবে তারা বোরো ধান কাটছেন। এরপর তিনবেলা খাবারসহ সব খরচ জমির মালিক দেন।

এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় শুরু হয়নি। এলাকার সাধারণ কৃষকদের প্রাণের দাবি, দালাল, ফড়িয়া সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান না কিনে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা হলে সরকারের মহৎ উদ্যোগ শুদ্ধ ও সুন্দর হবে। এদিকে ধান কেনা এবং মনিটরিংয়ের একটি কমিটি আছে। কয়েক দিন আগে ধান ক্রয়সংক্রান্ত একটি মিটিং করলেও এখনো ধান কেনা শুরু হয়নি বলে জানা গেছে।

কৃষকরা বলেন, ‘বর্তমানে ১ মণ ধানের দাম ৫০০ টাকা, অথচ এই ১ মণ ধান উৎপাদন করতে কৃষকদের খরচ হয়েছে ৬০০ টাকা।

সদর উপজেলার কৃষক দুলাল হাওলাদার বলেন, ‘আমি কম দাম দেখে আমার ধান বিক্রি করিনি। দাম বেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব’। প্রায় ৪০ শতাংশ ধান কাটার আগেই কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধানের দাম মন প্রতি ৭০০ – ৮০০ টাকা না হলে সকল পরিশ্রমই বৃথা যাবে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কৃষকরা। তাদের দাবি, প্রতি মণ ধানের দামে ৭০০-৮০০ টাকায় দাম বাড়াতে হবে।

যদিও সরকারি ২৮ টাকা কেজি দরে ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিয়েছে, তবে খাদ্য বিভাগ এখন পর্যন্ত ধান ক্রয় শুরু করেনি। এদিকে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা ফল কাটার পরবর্তী মাঠ দিবস করতে গিয়ে ধানের দাম না থাকায় কৃষকদের রোষাণলে পড়েছেন। কৃষকরা তাদের জানিয়েছে, ধানের দাম না বাড়লে তারা কোনো ধরনের ধানের আবাদ করবে না।

নলছিটি উপজেলার প্রেমহার গ্রামের বাম্পার ফলন উৎপাদনকারী কৃষক ইউনুচ মাঝি বলেন, ‘তিনি ক্ষতির হিসেব করছেন। লাভ না হলে তার পক্ষে বোরো ধানের চাষ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না’।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ফজলুল হক জানান, কৃষকরা যাতে ন্যায্য মূল্য পায় তা নিশ্চিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত এর দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হয়নি।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *