তিন দশকের অর্জন হারানোর পথে অস্ট্রেলিয়া

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কয়েক দফায় সংকট তৈরি হলেও গত প্রায় ২৯ বছরের মধ্যে কোনো ধরনের মন্দায় পড়তে হয়নি অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিকে। তবে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে হয়তো এবার সে ধারায় ছেদ পড়তে চলেছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) অস্ট্রেলিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। আরো বড় সংকোচনের আশঙ্কা রয়েছে চলতি প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন)। খবর ব্লুমবার্গ।

শুধু মন্দাই নয়, ছোটখাটো সংকোচন থেকেও নিজেদের অর্থনীতিকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ২০১১ সালের পর এই প্রথম কোনো প্রান্তিকে অস্ট্রেলিয়ার জিডিপি সংকুচিত হলো। আর এ সংকোচনের অন্যতম কারণ হলো করোনার প্রভাবে গৃহস্থালি ব্যয় কমে যাওয়া।

অস্ট্রেলিয়ার পরিসংখ্যান ব্যুরো গতকাল জিডিপির এ উপাত্ত প্রকাশ করেছে। এর পর পরই মার্কিন ডলারের বিপরীতে কিছুটা মান হারায় অস্ট্রেলিয়ান ডলার। এদিন বেলা ১টার দিকে সিডনিতে প্রতি অস্ট্রেলিয়ান ডলার ৬৯ দশমিক ৩২ সেন্টে লেনদেন হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি সংকোচনের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। বাস্তবে হয়েছে দশমিক ৩ শতাংশ। এ হিসাবে প্রথম প্রান্তিকে অস্ট্রেলিয়ার জিডিপিতে পতন আশঙ্কার চেয়ে কিছুটা কমই হয়েছে। তবে দ্বিতীয় প্রান্তিকের ফলাফলটা এমন আশাব্যঞ্জক না-ও হতে পারে। চলতি প্রান্তিকে আরো গভীর সংকোচনের আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মসংস্থান হারানোর কারণে এমন আশঙ্কা করা একেবারে অমূলক নয়। কেবল এপ্রিলেই দেশটিতে চাকরি হারিয়েছে ছয় লাখ মানুষ। আর কাজ নেই মানে আয়ের পথও বন্ধ। আয় না থাকলে গৃহস্থালি ব্যয় কমবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে জিডিপিও সংকুচিত হবে। রেকর্ড প্রায় ২৯ বছর টানা দুই প্রান্তিকে জিডিপির সংকোচন এড়াতে সক্ষম হলেও এবার মনে হয় তা আর পারবে না তারা। অথচ ১৯৯৭ সালে এশিয়ার আর্থিক সংকট, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকের ডটকম বাবল ও ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময়েও এ ধরনের মন্দায় পড়তে হয়নি অস্ট্রেলিয়াকে।

পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর অস্ট্রেলিয়ার ট্রেজারার জশ প্রাইডেনবার্গকে প্রশ্ন করা হয়, দেশটির অর্থনীতি মন্দার মধ্যে রয়েছে কিনা। উত্তরে তিনি ভাগ্যের এ নির্মম পরিহাস স্বীকার করে নিয়েছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আপনাদের প্রশ্নের উত্তর হলো, হ্যাঁ। চলতি প্রান্তিকের গতিপথ নিয়ে এখন পর্যন্ত রাজস্ব বিভাগের কাছ থেকে আমি যে আভাস পেয়েছি, তার ভিত্তিতেই একথা বলছি।’

পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম প্রান্তিকে অস্ট্রেলিয়ায় গৃহস্থালি ব্যয় ১ দশমিক ১ শতাংশ কমে গেছে। এতে জিডিপির দশমিক ৬ শতাংশীয় পয়েন্ট সংকুচিত হয়েছে। এ সময়ে দেশটিতে সেবা খাতে ব্যয় কমেছে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। লকডাউনের বিধিনিষেধের কারণে ভ্রমণ, হোটেল, ক্যাফে ও রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ থাকায় সেবা খাতের ব্যয়ে এ পতন দেখা গেছে।

জানুয়ারি-মার্চ মেয়াদে অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি ব্যয় ১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে, যা জিডিপিতে দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট যোগ হয়েছে। মহামারীর সংকটপূর্ণ সময়ে আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখায় এ ব্যয় চলতি প্রান্তিকেও বাড়তির দিকে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে অস্ট্রেলিয়ায় সঞ্চয় অনুপাত ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আলোচ্য তিন মাসে দেশটিতে আবাসন খাতে নির্মাণকাজ ১ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। খনিবহির্ভূত ব্যবসায় বিনিয়োগও কমেছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে খনি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

কমোডিটির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার খনি ব্যবসায়ীদের মুনাফা সক্ষমতাও বেড়েছে। প্রথম প্রান্তিকে দেশটির কমোডিটি রফতানি বেড়েছে ২ দশমিক ৯ শতাংশ। এর ফলে দেশটির চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত রেকর্ড ৮৪০ কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবে মুনাফা সক্ষমতা বাড়লেও খনির মালিকরা এখনো সতর্ক অবস্থানেই রয়েছেন। তারা নিয়মিত অস্ট্রেলিয়ান ডলারের মানের দিকে চোখ রাখছেন, যা গত আড়াই মাসে মার্কিন ডলারের বিপরীতে প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে।

লকডাউনের বিধিনিষেধ শিথিল হতে শুরু করায় অস্ট্রেলিয়ার অর্থনৈতিক পূর্বাভাস কিছুটা ভালো হতে শুরু করেছে। তবে আন্তঃসীমান্ত চলাচল এখনো বন্ধ থাকায় দেশটিতে পর্যটক ও বিদেশী শিক্ষার্থীদের প্রবেশ ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে অর্থনীতির ওপর চাপ আরো কিছুদিন থাকবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এদিকে সরকার আবাসন খাতে নির্মাণ কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনতে নতুন করে আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণার বিষয়ে আলোচনা করছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *