গুগলকে বিভক্ত করার উপায় খুঁজছে মার্কিন সরকার

অ্যালফাবেট ইনকরপোরেশন নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি জায়ান্ট গুগলের আধিপত্য কমাতে চাইছে মার্কিন সরকার। যে কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে বিভক্ত হয়ে সেবা দিতে বাধ্য করা হতে পারে। আর এরই অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েব ব্রাউজার ক্রোম এবং বিজ্ঞাপন ব্যবসা বিভাগ বিক্রিতে চাপ দেয়া হতে পারে। বৈশ্বিক ডিজিটাল বিজ্ঞাপন খাতে একচ্ছত্র আধিপত্য কমাতে তাই গুগলকে বিভক্তের উপায় খুঁজছে মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। সংবাদ মাধ্যম পলিটিকার এক প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছে।

বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতে একচেটিয়া ব্যবসা অনুশীলনের জন্য টানা কয়েক বছর ধরে তীব্র সমালোচিত হচ্ছে গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক ও ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজন ইনকরপোরেশনের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো। বিভিন্ন কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনেক দেশে অ্যান্টিট্রাস্ট ইস্যুকে কেন্দ্র করে তদন্ত চলছে। এসব প্রযুক্তি জায়ান্টের বিরুদ্ধে ভুয়া সংবাদ ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার অভিযোগ ক্রমে বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন কৌশলে চাপে ফেলে তুলনামূলক ছোট প্রতিদ্বন্দ্বীদের অধিগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের ব্যবসা সাম্রাজ্যের বিস্তার করার।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী সপ্তাহে কোনো এক সময় মার্কিন বিচার বিভাগ গুগলের বিরুদ্ধে একটি পৃথক অ্যান্টিট্রাস্ট মামলা দায়ের করতে পারে। এ মামলার ফোকাস থাকবে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটির বৈশ্বিক অনুসন্ধান খাতে একচ্ছত্র আধিপত্যের বিষয়টিতে। অর্থাৎ অনুসন্ধান খাতে নিজেদের একক আধিপত্য ধরে রাখতে গুগল কোন ধরনের অন্যায্য সুবিধা নিয়ে আসছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। বৈশ্বিক অনুসন্ধান খাতে গুগল নিজেদের সেবাগুলোকে এগিয়ে রাখছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে তুলনামূলক ছোট প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যবসার দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তী ধাপে প্রতিষ্ঠানটির ডিজিটাল বিজ্ঞাপন খাতে প্রতিষ্ঠানটির একচেটিয়া ব্যবসা অনুশীলনের বিষয়ে তদন্ত করা হবে। পলিটিকার ভাষ্যে, গুগলকে ওয়েব ব্রাউজার ক্রোম বিভাগ এবং ডিজিটাল ব্যবসা বিভাগের একটি অংশ বিক্রিতে বাধ্য করতে পারে মার্কিন নিয়ন্ত্রকরা।

বৈশ্বিক ওয়েব ব্রাউজার বাজারে একক আধিপত্য বিস্তার করেছে গুগল ক্রোম। এখন সামগ্রিকভাবে বাজারটির ৬৬ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ক্রোম ব্রাউজার। এছাড়া মোবাইল ব্রাউজার বাজারের ৬৪ শতাংশ ক্রোমের দখলে রয়েছে। যে কারণে মনে করা হচ্ছে, ক্রোমের ওপর ভর করে ১৬ হাজার ২৩০ কোটি ডলারের বৈশ্বিক ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাজার থেকে অন্যায্য সুবিধা নিচ্ছে গুগল।

গুগল অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম, অনুসন্ধান ও অনলাইন নানা সেবার পাশাপাশি হার্ডওয়্যার খাতে ব্যবসা জোরদারে চেষ্টা চালাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত বছরের নভেম্বরে ২১০ কোটি ডলারে পরিধেয় প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা ফিটবিট অধিগ্রহণে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ অধিগ্রহণ চুক্তি পরিধেয় হার্ডওয়্যার বাজারে গুগলের প্রবেশ নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে পরিধেয় প্রযুক্তি পণ্য বাজারে শুধু ওয়্যারওএস নয়; হার্ডওয়্যার সরবরাহেও প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাপল এবং স্যামসাংকে টেক্কা দিতে জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য গুগলের এ অধিগ্রহণ চুক্তিতে বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। বলা হচ্ছিল, গুগলের ফিটবিট অধিগ্রহণ চুক্তির ফলে ডাটা সুরক্ষা ঝুঁকিতে পড়বে। গুগলের ফিটবিট অধিগ্রহণের ফলে বাজার প্রতিযোগিতা প্রভাবিত হবে কিনা কিংবা প্রতিষ্ঠানটির কাছে অনেক বেশি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের দখল চলে যাবে কিনা, সে বিষয় নিয়ে তদন্ত চালিয়েছে ইউরোপের নীতিনির্ধারক সংস্থাটি।

ফিটনেস ট্র্যাকিং ডিভাইস তৈরি করছে ফিটবিট, যা ব্যবহারকারীর হূদস্পন্দন, কার্যকারিতার পর্যায় ও ব্যবহারকারীর জিপিএস ডাটা পর্যবেক্ষণ এবং সে অনুযায়ী নানা শারীরিক অসংগতির তথ্য সরবরাহ করে। বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা শেষে গুগলের এ অধিগ্রহণ ঠেকানোর দাবি জানিয়েছিল ২০টি ভোক্তা সংগঠন এবং গোপনীয়তাবিষয়ক আইনজীবীদের একটি দল। অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছিল ইইউ। তবে পর্যালোচনা শেষে চুক্তিটির বিষয়ে সবুজ সংকেত প্রদানে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।

গুগল শুরু থেকে দাবি করে আসছিল, বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের স্বার্থে ফিটবিটের ডাটা ব্যবহার করবে না তারা এবং সংগ্রহ করা ডাটা বিষয়ে তারা স্বচ্ছ থাকবে।

গত জুলাইয়ে গুগলের ফিটবিট অধিগ্রহণের বিরোধিতা করে প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান জানায়, কারো এত বেশি ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা কোনো প্রতিষ্ঠানের উচিত বলে আমরা মনে করি না। আমরা এ অধিগ্রহণের বিরোধিতা করছি। গুগলের ফিটবিট অধিগ্রহণ পরিধেয় প্রযুক্তিপণ্য বাজারে অন্যায্য প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে এবং অসংখ্য ফিটবিট ডিভাইস ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলবে।

জানা যায়, গুগল ও ফিটবিটের বেশকিছু প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিস্তারিত প্রশ্নাবলি পাঠিয়েছেন ইইউর নীতিনির্ধারকরা। সম্ভাব্য এ অধিগ্রহণের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো অসুবিধায় পড়বে কিনা, সে বিষয়টিই জানতে চেয়েছে ইইউ। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, গুগল-ফিটবিট অধিগ্রহণ চুক্তি বিষয়ে চলতি বছর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না মেলার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

শুধু ইইউর অ্যান্টিট্রাস্ট কর্তৃপক্ষই নয়; গুগলের ফিটবিট অধিগ্রহণ চুক্তির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রক সংস্থাও। গুগলের বিরুদ্ধে ইউরোপে একাধিক তথ্য কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলমান। এ পরিস্থিতির মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ফিটবিটকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিলে ইউরোপ অঞ্চলের গ্রাহকদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। গুগলের ফিটবিট অধিগ্রহণ ইউরোপের নাগরিকদের জন্য তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়াবে।

ফিটবিট অধিগ্রহণ বিষয়ে গুগলের এক মুখপাত্র জানান, আমরা তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিধেয় ডিভাইস বাজারে ভালো কিছু পণ্য সরবরাহের লক্ষ্য থেকে ফিটবিট কিনতে সম্মত হয়েছি। এ অধিগ্রহণ চুক্তিটি বাস্তবায়নে বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। গুগলের ব্যবসার প্রধান শর্তই হলো গ্রাহকের তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আমরা বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। ফিটবিট অধিগ্রহণ নিয়ে কোনো দেশ বা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ থাকলে আমরা তাদের সহায়তা করতে চাই। গুগলের ফিটবিট অধিগ্রহণ পরিধেয় ডিভাইস বাজারে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *