আমাদের সবার মন তো ভেঙে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে

দেড় বছর দেশের বাইরে ছিলেন নৃত্যশিল্পী ও গবেষক লুবনা মারিয়াম। করোনাকালেই সম্পন্ন করলেন গ্র্যাজুয়েশন।টরন্টোতে থাকাকালীন গবেষণা শেষে তার দুটি সংগঠনের নানা কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। দেশে ফিরেও বর্তমানে নানা ধরনের সাংগঠনিক কাজের মধ্য দিয়ে মহামারীকালের এ সময় পার করছেন এ গুণী শিল্পী। সম্প্রতি টকিজের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। আলাপ করেছেন রাইসা জান্নাত

আপনি তো গবেষণার কাজে টরন্টোতে ছিলেন। লকডাউনের এ সময় দেশে ফিরলেন কীভাবে?

গবেষণার কাজ শেষে ভাবলাম আমি তো এখন দেশে ফিরতে পারব না। আর এখন বসে থাকার সময়ও নয়। তখন ঢাকায় সবার সঙ্গে যোগাযোগ করি। সবাই মিলে পরিকল্পনা করে ‘বাক্সবন্দি বৈশাখ’ নামে একটা অনলাইন প্রেজেন্টেশন করে ফেলি। এরপর টরন্টোতে বসেই ১২ দিনের একটা ওয়ার্কশপ করেছি। দিল্লি, বীরভূম, কলকাতা, কুষ্টিয়াসহ সারা দেশের ৪২ জন ক্লাস করেছে। এই ক্লাস নিতে নিতেই হঠাৎ করে আমাকে একজন জানায় বাংলাদেশ সরকার টরন্টো থেকে ঢাকায় একটা বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছে। আমি তড়িঘড়ি করে নাম লিখিয়ে ফেলি। আমাকে ডিপার্টমেন্ট থেকে বলেছিল, তুমি কেন যাচ্ছ? তোমার ওখানে অবস্থা ভালো না। তখন আমি বললাম, মরলে আমার দেশে মরব। তোমার দেশে কেন মরব? এভাবে ২২ তারিখ চলে এলাম দেশে।

 আপনি সম্প্রতি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। গবেষণার বিষয়বস্তু কী ছিল?

থিয়েটার পারফরম্যান্স স্টাডিজ নিয়ে। পারফরম্যান্সের মাধ্যমে কীভাবে এথনোগ্রাফিক বা মানুষের মধ্যে কীভাবে নৃতাত্ত্বিক গবেষণা করা যায়। আমি পারফরম্যান্স এথনোগ্রাফির পরিবর্তে ইমাজিনেটিভ এথনোগ্রাফি করেছি। সেলফোন এথনোগ্রাফি। করোনাভাইরাসের মধ্যেই কাজ করেছি। কোর্সটা ছিল এক বছরের। কিন্তু ওশান ডান্স ফেস্টিভ্যালের কারণে ছয় মাস কাজ বন্ধ রেখে দেড় বছরে তা শেষ করলাম। আমরা চেষ্টা করব নৃত্য সংগঠন সাধনার মাধ্যমে গবেষণার এ চিন্তাটা ছড়িয়ে দেয়ার।

 অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে গবেষণা শেষ করলেন। কারোনার এ সময় সাংসৃ্কতিক কর্মীরা অনলাইনভিত্তিক নানা কার্যক্রম করছে। সেগুলোর মান নিয়ে আবার নানা প্রশ্ন উঠছে। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা…

অনলাইনে কবিতা পাঠ, নাটক করা এসব নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলছেন। কিন্তু আমি মনে করি সবাই এভাবে বিশেষ সময়ের সদ্ব্যবহার করছে। এগুলো মানসম্পন্ন হওয়ার দরকার নেই। নিজেকে ব্যস্ত এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটাই এখন মূল উদ্দেশ্য। তাছাড়া আমাদের সবার মন তো ভেঙে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। নিজের মনকে ভালো রাখতে যদি কেউ নাচ-গান করে, সেটা তো অন্যায় কিছু না। আমি এর আগে আমাদের সংগঠন কল্পতরুর শিক্ষকদের বলেছি অনলাইনে ক্লাস নিতে। খুব ভালো ক্লাস হয়েছে। প্রতি মাসে একটা দিনও ক্লাস মিস করিনি। শিক্ষকদের বেতনও দেয়া হয়েছে। পথশিশুদের নিয়েও একটা স্কুল চালাই। তারা বসে আছে। ভাবছি কীভাবে তাদের স্মার্টফোন দিয়ে অল্প ইন্টারনেট খরচে লেখাপড়া করানো যায়।

 এ উদ্যোগ সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জানতে চাই।

স্কুলটার নাম ‘দীপশিখা’। গুলবাগে অবস্থিত। প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থী আছে। আমার মা ড. সুলতানা সারওয়াত আরা জামান, সুফিয়া কামাল, সারা যাকেরের মা, আলী আমিন, কবি গোলাম মোস্তফার মেয়ে ফিরোজা বেগমসহ আরো অনেকে মিলে সু্কলটা তৈরি করেছিলেন। এখন আমরা বন্ধুবান্ধবরা মিলে চালাই। ভালোভাবেই চলে। ঈদে শিক্ষার্থীদের টাকাপয়সাসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়েছি। কিন্তু ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে হবে তো। আমরা চিন্তা করছি স্মার্টফোন কিনে দেয়ার মাধ্যমে কীভাবে তাদের পড়াশোনা শুরু করা যায়।

 বাসায় এখন কীভাবে সময় কাটছে আপনার?

সংগঠনের নানা কাজ করছি। তারপর আমার মেয়ে আনুশেহ বাসায় সবাইকে ব্যস্ত রাখছে। নিমপাতার রসসহ অর্গানিক সব খাবার খাওয়াচ্ছে। আমাদের বয়স হয়েছে তো। এরপর প্রতিদিন টানা ৩ ঘণ্টা যোগব্যয়াম, ব্রিদিং ও ধ্যান করাচ্ছে। ব্যস্ত আছি বলে যে ভালো আছি সেটাও বলা যায় না। তবে আমি ভীষণ আশাবাদী। আমি মনে করি, মানুষ অনেক মেধাবী। কিছু একটা উপায় বের করবেই। আমার মা মারা গেছেন। আমি তখন টরন্টোতে। আসতে পারিনি। এটাই তো জীবন!

 করোনাভাইরাস তো নতুন করে সবকিছু ভাবতে শেখাচ্ছে…

নৃত্যশিল্পীরাও তাদের জায়গা থেকে চিন্তা করছে। শাস্ত্রীয় নৃত্য এত শক্তিশালী একটা মাধ্যম। এর মাধ্যমে পৃথিবীর কাছে অন্য বার্তা পৌঁছে দেয়া যায় কিনা আমরা ভাবছি।

 মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার বয়স ছিল সতেরো বছর। এখনো কি একটা যুদ্ধ চলছে…

এটা হলো বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ। এখানে সবাই সবাইকে সহায়তা করছে। ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে এ যুদ্ধ জয় করতে হবে। সবসময় অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে হয় না। আমরা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছি। কিন্তু এ প্রজন্মের অস্ত্র হলো প্রযুক্তি। ডিজিটাল প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কভিড-১৯-এর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হবে। আমাদের প্রজন্মের অনেকেই তো এখন অসুস্থ। সময়টা এখন বর্তমান প্রজন্মের। যুদ্ধটা তাদেরই করতে হবে। আমরা পাশে আছি।

 একটা সময় রাষ্ট্রভাবনার সঙ্গে সাংস্কৃতিক ভাবনার মেলবন্ধন ছিল। এখনকার প্রেক্ষাপটে আপনার কী মনে হয়?

আমরা সবসময় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি। কিন্তু একমত না হয়েও কীভাবে দেশের ভালোর জন্য কাজ করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যে দলকেই সমর্থন করা হোক না কেন রাষ্ট্র যদি ভালো কাজ করে তাহলে তার সঙ্গে থাকা উচিত। আবার রাষ্ট্র যদি কোনো ভুল পরিকল্পনা নিয়ে থাকে তাহলে সমালোচনাও করতে হবে। আমি মনে করি, সমালোচনাটা খুব প্রয়োজন। কিন্তু সেটা নোংরা সমালোচনা হওয়া উচিত নয়। ক্রিটিক্যাল চিন্তা থেকে করা উচিত। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সবসময় সোচ্চার থাকতে হবে। ভুলকে ভুল আর সঠিকটাকে সঠিক বলা শিখতে হবে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *