আগস্ট ১৪: ফর্মুলায় বেঁধে বাস্তবের নির্মাণ

রাইম থ্রিলার আগস্ট ১৪ দর্শক মনে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে। সাদামাটা চোখেও সেটা বোঝা যাচ্ছে। সিরিজটা দেখে শেষ করার দিনটা যখন রাতে গিয়ে ঠেকল, মেয়েকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা খুলে রেখেছিলাম। পাশের ঘরের বাতি জ্বালিয়ে মনে হয়েছিল একটু আলো থাক। মনে হচ্ছিল, এই আলো হয়তো অস্বস্তি বোধ থেকে আমাকে মুক্তি দেবে। রাত আরো গভীর হলে আমি কদাকার অস্বস্তিটা দূরে সরিয়ে যুক্তিদের আমন্ত্রণ করতে থাকি। কেন এমন হচ্ছে ভাবতে চেষ্টা করি। একটা মামুলি মিডিয়া কন্টেন্ট নিয়ে রাত জেগে ভাবছি, এ অনুভূতিটাও নিজেকে বিরক্ত করছিল বারবার। তার পরও ভাবনা ছাড়া এ অস্বস্তি দূর করার উপায় না পেয়ে আমি তাকে প্রশ্রয় দিই।

আবিষ্কার করি আগস্ট ১৪ আমাকে ২০১৩-তে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। এই বহুল আলোচিত ঘটনা টেক্সট হিসেবে বাছাই করার বুদ্ধিটাই অন্য রকম। পাবলিক মানসে ঐশী এখনো ভয়াবহভাবে উপস্থিত। ফলে তুশিও ঐশীর মতোই পাবলিক মানসে গেঁথে যায়। কারণ ঐশীকে দর্শক বা পাবলিক মানস যেভাবে দেখার আকাঙ্ক্ষা করে তুশি ঠিক সেভাবেই হাজির হয় আগস্ট ১৪-তে। কারণ ২০১৩-এর ওই ঘটনাকে পরিচালক মূল ঘটনার থেকে আরো বেশি রোহমর্ষক করে নির্মাণ করেন। এখানেই মিডিয়া বা সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গুয়েজের মজা। পরিচালক একবার সেটা ধরতে পারলে ম্যাজিক হয়ে যাবে। শিহাব শাহীন সেটা ধরতে পেরেছেন। তার চোখে তুশিকে আরো বেশি ভয়ংকর দেখাতে থাকে। তুশিকে আমরা দেখি ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের সঙ্গে হাতের রক্ত মুখে পুরে ফেলতে। ফলে ১৩ ও ২০ মিলিয়ে এ বিভীষিকা অন্য মাত্রা স্পর্শ করে। দর্শক এমন ঐশীকে দেখার জন্য এক রকম প্রস্তুতই ছিল। প্রয়োজন ছিল শুধু ঘি ঢালার। তুশিকে দিয়ে সেটা শাহীন ভালোই ঢেলেছেন। ফলে এ মিডিয়া কন্টেন্ট আর মামুলি থাকেনি। মধ্যবিত্ত দর্শকের ঘরে সে আলোচনার মধ্যমণি হয়ে বসে। আর গুড-ব্যাড প্যারেন্টিং, মাদক, মা-বাবার হত্যাকাণ্ড, ওয়েস্টার্ন পোশাক, উচ্ছৃঙ্খল, ইংলিশ মিডিয়াম, প্রচুর পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক—এমন সব পপুলার ডিসকোর্সে চেপে ব্যবসা হতে থাকে ষোলআনা।

দ্য ওয়ার্ল্ড অব সিনেমা কোর্সটা যখন পাঠ করছিলাম, আমাদের শিক্ষক এবং ভারতীয় চিত্র পরিচালক কে হরিহরণ বলেছিলেন, মেলোড্রামার পেছনের মেলোড্রামা চলচ্চিত্রকে ব্যবসাসফল বানায়। মানুষ যখন মূল টেক্সটের বহিরঙ্গের টেক্সট নিয়েও (আট কোটি পারিশ্রমিক নেয়া নায়িকা এ সিনেমায় একটি টাকাও নেননি বা সিনেমার পরিচালকের ডিভোর্সের কারণ তো তার ছবির নায়িকা ইত্যাদি) সমানভাবে মাথা ঘামায় তখন বুঝতে হবে স্টোরিটি দর্শক দেখবে। আর এখানে তো ভিতর-বাহির বলে কিছু নেই। সবই জানে দর্শক। আর এটা তো চলচ্চিত্র নয়, পরিবর্তিত নয়া বাস্তবতার কালে নির্মিত একটি ওয়েব সিরিজ। যেখানে মাত্র দুটো ক্লিক করে আপনি সাক্ষী হতে পারেন সেই রোহমর্ষক ঘটনার।

বাংলাদেশে ক্রাইম থ্রিলার বানানোর চলটা কম। যদি চলচ্চিত্রের কথা ধরি, জহির রায়হানের কখনো আসেনি (১৯৬১) শুরুতেই ক্রাইম থ্রিলার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়। তারপর অবশ্য ঘটনা বাঁক নিয়ে চলে যায় আরো গভীরে। এরপর মাসুদ রানা (১৯৭৪) বা ঢাকা অ্যাটাক (২০১৭)-কে সফল ক্রাইম থ্রিলার বলা যেতে পারে। সঙ্গে যুক্ত হলো এ সিরিজটি। তবে অন্য কন্টেন্টগুলোর চেয়ে এর পার্থক্য হলো, এই প্রথম আমরা একজন খলচরিত্রের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে সব দেখছি। যে তার ক্রোধ, কর্মকাণ্ড নিজেই ডিফাইন করে চলে। এখানে মূল চরিত্র আদতে তুশিই। সে একাই কাঁধে টেনে নিয়ে গেছে প্রায় ঘণ্টা চারেকের একটা গল্প। সাধারণত নারী চরিত্রের কাঁধে একটি ভিজুয়াল স্টোরি এককভাবে চাপিয়ে দিতে চান না পরিচালকরা। এক্ষেত্রে এটা সাহসী পদক্ষেপই বলব। তবে মজার বিষয়, এ চরিত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো শক্ত কাঁধ তাসনুভা তিশারও ছিল। এমন সুন্দর-সাবলীল অভিনয় তাকে আন্তর্জাতিক পরিসর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে বলে মনে করি। আর খালেদ চরিত্রটি তুশিকে সংগত করে চলে। পজিটিভ বলেই সে কিন্তু হিরো নয় বরং অ্যান্টি-ভিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।

এসব স্টোরি টেলিংয়ে বাইনারি অপজিশনের (ভালো বনাম খারাপ / ধনী বনাম গরীব) উপস্থিতি একটি অপরিহার্য বিষয়। এসব গল্পে ভালোকে ঊশ্বরতুল্য আর খারাপকে ইবলিশতুল্য দেখানোর প্রবণতা আছে। ক্লাসে পড়েছিলাম, শয়তান বা খলচরিত্র কেন খল, সেটার কোনো কারণ দর্শক জানতে পারে না। তেমনি নায়ক বা হিরো চরিত্রগুলো কেন ভালো তার কোনো কারণ নেই। মি. ইন্ডিয়া (১৯৮৭) চলচ্চিত্রে মানুষের ক্ষতি হলেই কেন মুগাম্বো খুশি হয়, তার কারণ আজও দর্শক জানে না। মজার বিষয় হলো, যখন খল বা শয়তান চরিত্রের সঙ্গে আপনি কারণ যোগ করেন তত্ক্ষণাৎ সে হিরো বা নায়ক হয়ে ওঠে। ফলে শিহাব শাহীনও এই সিরিজে ফর্মুলার বাইরে যাওয়ার ঝুঁকিটা নেন না।

তিনি তুশিকে হাজির করেন ভয়াবহ খলচরিত্র হিসেবে। কখনো অন্ধকারের মেয়ে, কখনো ধূর্ত শয়তান বা কখনো ইবলিশ নাম দিয়ে। কেন তুশিরা তুশি হয়ে ওঠে এই ‘কারণ’ তিনি যোগ করেন না। কারণ যুক্ত হলেই তুশি আর ধূর্ত শয়তান থাকে না, সে ভিকটিম হয়ে যায়। দর্শকের সহানুভূতিতে চরিত্রটি আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে তার ‘হিরো’ চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার শর্ত তৈরি হয়। শিহাব শাহীন, তুশিকে হিরো বানানোর কোনো ঝুঁকিতেই যান না। একদম ফর্মুলার মাঝে থেকেই তুশির বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেন পরিবার, রাষ্ট্র এমনকি সমাজকেও। বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোরী বনাম রাষ্ট্রের লড়াই বুঁদ হয়ে দেখে দর্শক। মা-বাবা কখনো ভুল করতে পারে না, মা-বাবা যা করে সন্তানের ভালোর জন্যই করে এসব প্রচলিত ধারণাকে সম্পূর্ণ সমীহ করেছেন শাহীন। ইয়াবা, মাদক কীভাবে স্কুল, সেখান থেকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যায়, এ ধরনের প্রশ্নকে সন্তর্পণে এড়িয়েই গেছেন তিনি।

একটা ভিজুয়াল স্টোরি যখন নির্মিত হয়, তখন সেটাকে দুভাবে আমরা পাঠ করি। ‘কী বলা হলো’ এবং ‘কীভাবে বলা হলো’? দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে যে চর্চা জারি আছে, সেখানে আমরা শুধু ‘কী বলা হলো’ তা নিয়ে আলোচনা করতে থাকি। কিন্তু একটি সিনেমা, নাটক বা সিরিজ কীভাবে বলা হলো এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। শিহাব শাহীনের এ সিরিজটি বলার ধরন সুন্দর। সেট, প্রপস, লোকেশন, ব্লকিং ও আবহসংগীতে তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। আর চরিত্র নির্বাচন এ সিরিজের মূল শক্তি বলে আমার মনে হয়েছে। রিম্যান্ড ঘরে রহস্যময় কাচের এপার-ওপারে চরিত্রের ব্লকিং, ক্যামেরার কাজ ভালো লেগেছে। কিছু জায়গায় কন্টিনিউটি ব্রেক হয়েছে, তবে উতরে গেছে। শিহাব শাহীন পরিচিত তার রোমান্টিক জনরার কাজগুলোর জন্য। তবে কুহক সিরিজে তার ক্রাইম থ্রিলার বানানোর ঝোঁক চোখে পড়ে, সেটা এসে পরিণত রূপ নিয়েছে আগস্ট ১৪।

বিশ্বায়নের যুগে অজস্র বিদেশী মিডিয়া কন্টেন্টের ভিড়ে দেশের মানুষ অনেকদিন পর দেশের কোনো কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনার ঝড় তুলেছে। দেশের নির্মাতারা যখন নানাভাবেই টিকে থাকবার সংগ্রাম করছেন, টাকার জোগান নেই বলে ভালো কাজগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছে তখন সোস্যাল মিডিয়া, পত্রপত্রিকায় একটি ওয়েব সিরিজ নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে লেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে; হতে পারে সেটা কখনো চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বা কখনো প্রবল অস্বস্তি, ভয় বা বিরোধিতা থেকেই। কিন্তু হচ্ছে তো, এই বা কম কিসে?

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *