অনলাইনে ঘুঙুরের ঝংকার

করোনা মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন হলো নৃত্যশিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম ও আনুষ্ঠানিক পারফরম্যান্স থমকে আছে। যদিও ঘরে থেকে নিজস্ব পরিসরে শিল্পীরা নৃত্যের মাধ্যমে মানসিক স্বস্তি ও বিনোদিত করার কাজ করে যাচ্ছেন। এ মাসের শুরুতে লকডাউন তুলে দেয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু নৃত্য একটি গুরুমুখী বিদ্যা। যেখানে গুরু হাতে ধরে তার শিক্ষার্থীদের নৃত্য শেখান। সামাজিক দূরত্ব বজায়ের এ সময় আগের মতো নৃত্য কার্যক্রম শুরু করা অনেকখানি কঠিন। এছাড়া করোনা সংক্রমণের ভয় থেকেও অনেক শিক্ষার্থী নাচের ক্লাসে আসতে চাইবে না বলে মনে করছেন নৃত্যশিল্পীরা। স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হতে আরো বেশ খানিকটা সময় প্রয়োজন।

তাহলে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ কী? শিক্ষার্থীরাইবা কতদিন নৃত্যচর্চাবিহীন সময় কাটাবে? যেকোনো প্রতিবন্ধকতায় মানুষ ভিন্ন কোনো পথ খুঁজেই নেয়। প্যানডেমিকের এ সময় বিশ্বজুড়ে অনলাইন প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে এক নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। দেশের বাইরে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে অনলাইন প্লাটফর্মকে কেন্দ্র করে নৃত্য শেখানোর কার্যক্রম। বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে গুরুরা তাদের শিক্ষার্থীদের নাচ শেখাচ্ছেন। সম্প্রতি দেশেও এ ধরনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ উদ্যোগ গ্রহণকারীদের মধ্যে ক্লাসিক্যাল নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ওয়ার্দা রিহাব অন্যতম।

এ বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে অনেকেই অনেকবার অনলাইন ক্লাসের জন্য আমাকে বলেছিলেন। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তখন নিতে পারিনি। এখন যেহেতু আমরা সবাই গৃহবন্দি। এজন্য এটা শুরু করলাম।’ কতজন শিক্ষার্থীকে নাচ শেখাচ্ছেন? ‘ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস করছে। এছাড়া ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছে।’

অনলাইনে নৃত্য শেখানোর কার্যক্রমটি কীভাবে চালাচ্ছেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ওয়ার্দা বলেন, ‘পাঁচটি ব্যাচে শিক্ষার্থীদের ভাগ করে নিয়েছি। সপ্তাহে দুদিন করে তারা শিখছে। গুগল মিট অ্যাপের মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছি। সেখানে জুনিয়র, সিনিয়র, উচ্চ মাধ্যমিক সব ধরনের ব্যাচ রয়েছে।’ তার নাচের দল ধৃতি নর্তনালয়ের পুরনো শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নতুন ব্যাচ খোলা হয়েছে। যেখানে ঢাকা ও দেশের বাইরের ছেলেমেয়েরা নাচ শিখছে। কাজেই সপ্তাহজুড়েই এ শিল্পীকে ক্লাস নিতে হচ্ছে বলে জানালেন।

দিনের কোন কোন সময় নৃত্য শেখানোর কাজে ব্যয় করছেন? ‘বেলা ৩টা থেকে শুরু করি। ৫০ মিনিট করে ক্লাস নিচ্ছি। এভাবে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলতে থাকে। এরপর দেশের বাইরে যেসব শিক্ষার্থী আছে, তাদের বাংলাদেশ সময় ৮টা থেকে ক্লাস করানো হয়।’

অনলাইনে নৃত্য শেখানোর মধ্য দিয়ে নিশ্চয় নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার হচ্ছে এ নৃত্যশিল্পীর। অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলেন, ‘অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে ঢাকার বাইরের ছেলেমেয়েদের নৃত্য শেখাতে পারছি। এটা একটা বড় অর্জন। তারাও উপকৃত হচ্ছে, আর আমিও তাদের কাছে পৌঁছতে পারছি। এ পরিস্থিতিতে এটা একটা ইতিবাচক দিক বলে আমার মনে হয়।’

প্রতিবন্ধকতাও নিশ্চয় রয়েছে? ‘নাচ তো গুরুমুখী বিদ্যা। গুরুর সঙ্গে সঙ্গে শেখা। অনলাইনে এটা হচ্ছে না। বারবার মনে হচ্ছে, সামনে পেলে হয়তো আরো ভালো করে শেখাতে পারতাম। তবে চেষ্টা করছি একেকটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আলাদা করে নজর দিয়ে শেখাতে। এভাবে যতটুকু করা যায়।’

ওয়ার্দা রিহাবের মতে, তার এ কার্যক্রম দেখে এখন অনেকেই অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। দেশের নৃত্য শিক্ষকরা সবাই এমন কার্যক্রম শুরু করলে ভালো হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি। বলেন, ‘সাংস্কৃতিক চর্চা কবে শুরু হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হয়তো আরো সময় লাগবে। তাই দীর্ঘ সময় বসে না থেকে সবারই ধীরে ধীরে এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু করা উচিত।’

‘প্রথম দিকে কিছুটা অসুবিধা হবে। যেমন নেটওয়ার্ক সমস্যা। এগুলো অনুশীলনের বিষয়। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশও পিছিয়ে থাকবে না। পারফরম্যান্সের দিক থেকে দেশ এখন থমকে আছে ঠিকই। কিন্তু শেখার দিক থেকে যেন আটকে না থাকে এটাই এখন প্রত্যাশা।’—তিনি যোগ করেন।

এ কার্যক্রমের পাশাপাশি অনলাইনভিত্তিক একটি নৃত্য প্রতিযোগিতার বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন ওয়ার্দা রিহাব। গত মাসে ঢাকার মতিঝিল অর্কিড লিও ক্লাব আয়োজিত এবং জেরোসল্যাব নিবেদিত অনলাইন ডান্স রিয়েলিটি শো ‘স্বপ্নসিঁড়ি’ ২০২০ শুরু হয়। যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে।

এ বিষয়ে ওয়ার্দা বলেন, ‘প্রতিযোগী নির্বাচনের এখন দ্বিতীয় পর্ব চলছে। প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থী এতে অংশ নিয়েছিল। সেখান থেকে আমরা দুই ভাগে ৮০ জনকে নির্বাচন করেছি। শিগগিরই প্রতিযোগিতার তৃতীয় পর্ব শুরু করব আমরা।’

সচরাচর যেকোনো প্রতিযোগিতা মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়। অনেক আলোকসজ্জার উপস্থিতি চোখে পড়ে। কিন্তু অনলাইনভিত্তিক এ প্রতিযোগিতায় সেসব নেই। তবুও শিক্ষার্থীরা যে যার বাড়িতে স্থান নির্বাচন করে সাধ্যমতো মঞ্চ সজ্জা করে নৃত্য পরিবেশন করছে। ওয়ার্দার মতে, এটাই এ প্রতিযোগিতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একজন কোরিওগ্রাফারকে নিজের নৃত্যসহ আনুষঙ্গিক অনেক বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয়। এ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোরিওগ্রাফির ধারণাও তৈরি হচ্ছে।

করোনার কারণে নৃত্যশিল্পও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ শিল্পকে নিয়ে কী ভাবছেন নৃত্যশিল্পীরা? এ প্রসঙ্গে ওয়ার্দা রিহাব তার ভাবনার জায়গা থেকে বলেন, ‘এ সময় ডিজিটাল প্লাটফর্মে পেমেন্টের সঙ্গে শিল্পীদের কাজ করা উচিত। কারণ নৃত্যের সঙ্গে তাদের জীবিকার প্রশ্ন জড়িত। এক্ষেত্রে নৃত্যশিল্পী সংস্থাগুলো ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’

এদিকে শিল্পকলা একাডেমি এরই মধ্যেই এ ধরনের কার্যক্রম শুরু করেছে বলে তিনি জানালেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন উদ্যোগকে আশার আলো হিসেবে দেখছেন এ শিল্পী।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *