অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এমনভাবে সোজেছে যেন বিয়ে বাড়ি এবং বাংলাদেশের পার্সপেক্টিভ থেকে এটা মোটেও বাড়াবাড়ি নয়। কারণ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশকে যা দিয়েছে প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্য কেউ এর ধারেকাছেও দিতে পারেনি। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যা দিয়েছে বাংলাদেশের সরকারগুলো কি কখনো তার বিনিময় দেওয়ার চেষ্টা করেছে? যদি করতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এমন অমানবিকভাবে থাকতো না। তাদের থাকার জায়গা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া খুবই খুবই নি¤œমানের। অথচ কেউ দাবিও জানায় না। এটা মানতেই হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণালী দিন ছিলো জন্মের পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। এরপর থেকে এর অধঃপতনের দিকে যাত্রা শুরু। ভারত ভেঙে পাকিস্তান হলে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কখনোই তৎকালীন পূর্ববাংলার উন্নয়নে নজর দেয়নি। ফলে শিক্ষা ও গবেষণা থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকাস শিফ্ট হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কেন্দ্রীভ‚ত হয়। এই যে শিফট হয়েছিলো সেখান থেকে আমরা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ শিক্ষা ও গবেষণায় ফিরে যেতে পারিনি। এসবের কারণ হলো দলান্ধ ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি। ছাত্র রাজনীতির আগের সেই অতীত ঐতিহ্য নেই কারণ যেই পরিবেশ অতীত ঐতিহ্য তৈরি করেছিলো সেই পরিবেশ এখন আর নেই। নতুন বাংলাদেশে যেমন ছাত্র রাজনীতি হওয়ার কথা ছিলো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমরা কখনো সেই পথে হাঁটিনি। অথচ এই ৫০ বছরে বিশ^ রাজনীতি, বিশ^ অর্থনীতি এবং বিশ^ পরিবেশের আমূল পরিবর্তন এসেছে। আমরা সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইতে পারে এমন রাজনীতি তৈরি করিনি। আমাদের রাজনীতি হলো কাঁদা ছোড়াছুড়ি আর বড্ড বেশি অতীতমুখী।
আলোকসজ্জা ছাড়াও শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেই পরিমাণ টাকা যেইসব ক্ষেত্রে খরচ করছে সেই খরচ কতোটা যৌক্তিক? যেমন প্রতিটা বিভাগককে একটি করে বই লিখতে বলা হয়েছে এবং প্রায় প্রতিটা বিভাগ থেকেই একটি করে বই প্রকাশ করছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত জার্নালগুলো বিশেষ সংখ্যা বের করছে। এই দুটো কাজ কি আদৌ প্রয়োজন ছিলো? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে অবহেলিত খাতটি হলো গবেষণা এবং সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ হলো গবেষকরা। শতবর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে এটিও আমরা একেবারে ভুলে গেছি। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল উদ্দেশ্য (শিক্ষা ও গবেষণা) আবার পুনরুদ্ধার করা যায় সেই বিষয়ে তেমন আলোচনা ও অ্যাকশন প্ল্যান হয়নি। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ কেমন সেটা গত কয়েকদিনের সংবাদ শিরোনাম দেখলেও টের পাওয়া যায়। যেমন ‘সন্ধ্যা নামলেই ছিনতাই আতঙ্ক ঢাবি ক্যাম্পাসে’, ‘ঢাবিতে ক্যান্টিনের দেয়াল ভেঙে আহত ২’, ‘ঢাবির এফএইচ হলের রুমে রুমে গিয়ে ছাত্রলীগের হুমকি’। এসব কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ শিরোনাম হতে পারে? এই পরিবেশ থেকে মুক্তির কোনো আওয়াজ শুনছেন কোথাও?
[২] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মের প্রথম ৫০ বছর বাদ দিলে যা থাকে সেটা হলো স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল ইতিহাস। মেট্রো রেল, যখন তখন নতুন নতুন বিভাগ খোলা, ছাত্র শিক্ষক রাজনীতি ইত্যাদি ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কি কোন অর্জন আছে? ১০০ বছরের মধ্যে প্রথম ৫০ বছরতো ব্রিটিশ আর পাকিস্তানের শাসন ছিল। ওসব নিয়ে আদিখ্যেতা না দেখিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে আমরা কতটা এগিয়েছি বা পিছিয়েছি তার সার্জারি হতে পারতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গত ৫০ বছরের ইতিহাস হলো শিক্ষার্থীরা গণরুমে অমানবিকভাবে থাকে, হলের ছাদে ঘুমায়, গেস্ট রুম নামক টর্চার সেলে মার খায় আর অপমানিত হয়, অতীব নি¤œমানের খাবার খায়। আবাসিক হলে পড়াশুনার ন্যূনতম পরিবেশও নাই। আর আমরা শত বছর উদযাপন করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গর্বের কথা বললেই সত্যেন বোস, জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ, আর সি মজুমদারদের কাজ চলে আসে যা আসলে ব্রিটিশদের কৃতিত্ব। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোল নিয়ে গর্ব করা যায় কিন্তু সেটাও স্বাধীন বাংলাদেশের আগের ঘটনা। স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরিতে যেই বিশ্ববিদ্যালয় এত স্যাক্রিফাইস করল স্বাধীন দেশের সরকারেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উল্লেখযোগ্য কি করেছে? দিন যত গিয়েছে নতুন নতুন বিভাগ খুলে দলান্ধ শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এইটাকে ভাগাড়ে পরিণত করার কৃতিত্ব ছাড়া স্বাধীন দেশের সরকারদের আর কোন কৃতিত্ব নেই।
তাহলে শত বর্ষ নিয়ে এত আদিক্ষেতা কেন? এত আলগা দরদ কেন? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যত নামছে তার সাথে হাত ধরাধরি করে দেশে চোর বাটপার, ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ বাড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীতে একটি দেশের নাম করুন যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আর দেশের উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে আগায়নি। ব্যতিক্ৰম কেবল বাংলাদেশ। সেখানে দেশ নাকি উন্নত হচ্ছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষার মান নি¤œগামী। এইটা একটা গবেষণার উপাদান হতে পারে। কিন্তু গবেষণা করে সত্য ফলাফল প্রকাশের পরিবেশ কি এই দেশে আছে?
শত বছর উদযাপন না করে কলংকজনক শেষ অর্ধশত বছরের কথা ভেবে আমাদের বরং সরি বলা উচিত ছিল। সরি বলে এখন থেকে সঠিক পথে চলার প্রতিজ্ঞা করা উচিত ছিল।
লেখক : শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়