ইসলামে খোঁটা দেওয়া ঘৃণ্য কাজ

ইসলাম ডেস্ক: খোঁটা দেওয়া যে কত গর্হিত এবং আল্লাহ তাআলার কাছে কত ঘৃণ্য, হজরত আবূ যর (রাযি.)-এর একটি হাদিস দ্বারা তা অনুমান করা যায়। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ﺛَﻠَﺎﺛَﺔٌ ﻟَﺎ ﻳُﻜَﻠِّﻤُﻬُﻢُ ﺍﻟﻠﻪُ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ ﻭَ ﻟَﺎ ﻳَﻨْﻈُﺮُ ﺍِﻟَﻴْﻬِﻢْ ﻭَ ﻟَﺎ ﻳُﺰَﻛِّﻴْﻬِﻢْ ﻭَ ﻟَﻬُﻢْ ﻋَﺬَﺍﺏٌ ﺍَﻟِﻴْﻢٌ، ﻗَﺎﻝَ ﺍَﺑُﻮْ ﺫَﺭٍّ ﻓَﻘَﺮَﺃَﻫَﺎ ﺭَﺳُﻮْﻝُ ﺍﻟﻠﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَ ﺳَﻠَّﻢَ ﺛَﻠَﺎﺙُ ﻣِﺮَﺍﺭٍ، ﻗَﺎﻝَ ﺍَﺑُﻮْ ﺫَﺭٍّ : ﺧَﺎﺑُﻮْﺍ ﻭَ ﺧَﺴِﺮُﻭْﺍ، ﻣَﻦْ ﻫُﻢْ ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮْﻝَ ﺍﻟﻠﻪِ؟ ﻗَﺎﻝَ : ﺍَﻟْﻤُﺴْﺒِﻞُ ﻭَ ﺍﻟْﻤَﻨَّﺎﻥُ ﻭَ ﺍﻟْﻤُﻨْﻔِﻖُ ﺳِﻠْﻌَﺘَﻪ ﺑِﺎﻟْﺤَﻠِﻒِ ﺍﻟْﻜَﺎﺫِﺏِ.

‘তিন ব্যক্তি এমন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা যাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আবূ যর (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাটি তিন-তিনবার বললেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা কারা, তারা তো সর্বস্বান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল? তিনি বললেন, (ক) যে ব্যক্তি পরিধেয় কাপড় টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে রাখে; (খ) যে ব্যক্তি উপকার করার পর খোঁটা দেয় এবং (গ) যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য চালায়।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৬)

প্রথম পর্ব: উপকারের পর খোঁটা দেওয়া নিয়ে যা বলে ইসলাম

খোঁটা দেওয়া যে কত গুরুতর অপরাধ, এ হাদীস দ্বারা তা আঁচ করা যায়। বস্তুত খোঁটাদানকারী নিজেকে মহানুভবতার উচ্চস্তর থেকে হীনতার গভীর খাদে নামিয়ে আনেন। যে পরোপকার করে, সে তা আল্লাহর খলীফা হিসেবেই করে। সৃষ্টির উপর তার হাত যেন আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের হাত। এরূপ হাত সম্পর্কে হাদীস বলছে-
ﺍَﻟْﻴَﺪُ ﺍﻟْﻌُﻠْﻴَﺎ ﺧَﻴْﺮٌ ﻣِّﻦْ ﺍﻟﻴَﺪِ ﺍﻟﺴُّﻔْﻠٰﻰ

‘উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’ (সহীহ বুখারী: ১৪২৭)
[১] ঠাকুরগাঁওয়ে স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে স্বামীর মৃত্যু ≣ বাসা ছাড়ার নোটিশের খবরটি গণমাধ্যমে ভুল ভাবে ছড়িয়েছে, বললেন পরীমণি ≣ ভারতের নারী ফুটবল ক্লাবকে হারাল ইরানের মেয়েরা

দাতার হাত গ্রহিতার হাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। খোঁটা দ্বারা দান-উপকারের এই মহিমা নষ্ট হয়। কারণ বিনিময়ের আশাবাদী হওয়ার কারণে সে আর আল্লাহর প্রতিনিধি থাকে না। বাহ্যদৃষ্টিতে সে উপকারকারী হলেও প্রকৃতপক্ষে সে উপকারলাভের ভিখারী। সে উপকার করেছিল স্বার্থচিন্তায় তাড়িত হয়ে। কিংবা উপকার করার পর এখন সেই তাড়না বোধ করছে। সে তার উপকারকে ছলনার স্তরে নামিয়ে এনেছে। শিকারি যেমন সশ্যদানা ছিটিয়ে পাখি বা মাছ শিকার করে, তেমনি সেও উপকারের দানা ছিটিয়ে পার্থিব স্বার্থ হাসিল করতে চায়। তার হাত আর উপরের হাত থাকল না। নিচের হাত হয়ে গেল।

বান্দার সব আশা ও চাওয়া-পাওয়া তো হবে কেবল আল্লাহরই কাছে। কিন্তু খোঁটা দেওয়ার দ্বারা প্রমাণ হয়- সে মাখলূকের কাছে আশাবাদী ছিল। মাখলূকের কাছে আশাবাদ মনুষ্যত্বের মর্যাদাকে খর্ব করে এবং দৃষ্টিকে করে সংকীর্ণ। মাখলূক কতটুকুই বা দিতে পারে! অথচ আসমান-জমিনের মালিক দান-উপকারের যে বিনিময় ঘোষণা করেছেন, তা সৃষ্টির কল্পনারও অতীত।

খোঁটা দেওয়া একরকম অহমিকাও বটে। কারণ এর দ্বারা সে যাকে উপকার করেছে, তাকে নিজ কৃপাধন্য মনে করে। তাকে হীন ও ছোট ভাবে। অথচ দান-উপকার করা চাই ব্যক্তির মান-সম্ভ্রমের প্রতি লক্ষ রেখেই।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস (রাযি.) বলেন, “আমি যে কোনো ব্যক্তির উপকার করেছি। পরে দেখা গেছে তার ও আমার মধ্যে এক স্নিগ্ধময় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর যার প্রতি কখনও আমার দ্বারা মন্দ ব্যবহার হয়ে গেছে, পরে দেখতে পেয়েছি- তার ও আমার মধ্যে সম্পর্কে মলিনতা সৃষ্টি হয়েছে।”(উয়ূনুল-আখবার খ. ২, পৃ. ১৭৭)

সুতরাং দান-খয়রাত ও উপকার করার পরিণাম কখনও খারাপ হতে পারে না; যদি তাতে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিই উদ্দেশ্য থাকে এবং পরে কোনোরকম খোঁটা ও কষ্টদান না করা হয়ে থাকে।

উপরের আলোচনা দ্বারা বোঝা গেল, উপকার ও দান-খয়রাত করার পর খোঁটা দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এটা একটি মহাপাপ এবং বহু দোষের আকর। সর্বোপরি এটা ঈমান ও ইসলামের চেতনা-পরিপন্থী কাজ ও কাফের-বেঈমানদের বৈশিষ্ট্য। মুমিনদের এর থেকে বিরত থাকা অবশ্য-কর্তব্য।

বস্তুত উপকার করা অপেক্ষাকৃত উপকারকে হেফাজত করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এমনিতে উপকার করা তো একটি নফল কাজ, কিন্তু তার হেফাজত করা ফরজ এবং নষ্ট করা মহাপাপ। সেই হেফাজতের জন্যই কর্তব্য খোঁটাদান থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
ﯾٰۤﺎَﯾُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﯾْﻦَ ﺍٰﻣَﻨُﻮْﺍ ﻟَﺎ ﺗُﺒْﻄِﻠُﻮْﺍ ﺻَﺪَﻗٰﺘِﻜُﻢْ ﺑِﺎﻟْﻤَﻦِّ ﻭَ ﺍﻟْﺎَﺫٰﯼ.

অর্থ : ‘হে মু’মিনগণ! তোমরা তোমাদের দান-সদকাকে প- করো না খোঁটাদান ও কষ্ট দেওয়ার দ্বারা।’ (সূরা বাকারা ২ : ২৬৪)

কারও উপকার করার পরে কোনো অবস্থাতেই যাতে খোঁটাদানের অপরাধ ঘটে না যায়, সেজন্য কয়েকটি নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে-

১. উপকার করার সময় এবং তার পরও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের চেতনাকে অন্তরে জাগ্রত রাখা। কিছুতেই পার্থিব কোনো বিনিময়ের আশাবাদী না হওয়া। সে বিনিময় বৈষয়িক হোক বা সুনাম-সুখ্যাতি হোক কিংবা হোক উপকৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা।

২. উপকার করার সময় এবং তার পরও ওই ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখা। মনে করতে হবে প্রকৃতপক্ষে সেই আমার উপকারকারী। কেননা আমার কাছে সাহায্য চেয়ে এবং আমার উপকার গ্রহণ করে সে আমাকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।

এ ব্যাপারে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাস (রাযি.)-এর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “আমি তিন ব্যক্তির বদলা দিতে সক্ষম নই। (ক) যে আমাকে প্রথম সালাম দেয়; (খ) যে আমাকে মজলিসে বসার সুযোগ করে দেয় এবং (গ) যে সালাম-কালামের ইচ্ছায় আমার কাছে আসার জন্যে নিজ পদযুগলকে ধুলোমলিন করে। আর চতুর্থ এক ব্যক্তি আছে- আমার পক্ষ থেকে এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তাকে বদলা দিতে পারবে না। জিজ্ঞেস করা হল, সে কে? তিনি বললেন- ওই ব্যক্তি, যে কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়েছে, তারপর সারা রাত চিন্তা করেছে সাহায্যের জন্য কার কাছে যাবে। অবশেষে আমাকেই তার উপযুক্ত মনে করল এবং আমার কাছে এসে তার সেই মসিবতের কথা বলল।”(উয়ূনুল-আখবার খ. ২, পৃ. ১৭৭)

৩. নিজের দান-খয়রাত ও উপকারকে ক্ষুদ্র গণ্য করা। অর্থাৎ কল্পনা করতে হবে যে, তার যা প্রয়োজন সে অনুপাতে আমি অতি সামান্যই করতে পারছি। আমার যা করণীয় ছিল, সে অনুযায়ী যা করছি তা খুবই নগণ্য।

৪. উপকারের বিষয়টাকে গোপন রাখা। অর্থাৎ যার যেই উপকার করা হবে, যথাসম্ভব তা গোপন রাখার চেষ্টা করতে হবে। কেননা প্রকাশ করলে যেমন এখলাস নষ্ট হতে পারে, তেমনি তা একরকম খোঁটায়ও পর্যবসিত হবার আশঙ্কা থাকে। কেননা উপকারের কথা যদি প্রচার করে বেড়ানো হয় আর এভাবে তা তার কানে গিয়ে পৌঁছায়, তবে তা তার জন্যে নিশ্চিত পীড়াদায়ক হবে।

এ ব্যাপারে একটি হাদীস স্মরণ রাখা যেতে পারে-
ﺭَﺟُﻞٌ ﺗَﺼَﺪَّﻕَ ﺑِﺼَﺪَﻗَﺔٍ ﻓَﺎَﺧْﻔَﺎﻫَﺎ ﺣَﺘّٰﻰ ﻟَﺎ ﺗَﻌْﻠَﻢَ ﺷِﻤَﺎﻟُﻪ ﻣَﺎ ﺗُﻨْﻔِﻖُ ﻳَﻤِﻴْﻨُﻪ.

‘ওই ব্যক্তি, যে কোনও দান-সদকা করে এবং তা গোপন রাখে এমনকি তার বামহাত জানে না ডানহাত কী খরচ করে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৩১)

৫. উপকার করার কথা ভুলে যাওয়া। জনৈক ব্যক্তি তার সন্তানদের উপদেশ দিয়েছিল- তোমরা যদি কারও কোনো উপকার করো, তবে তা ভুলে যেও। কেননা তা স্মরণ রাখলে খোঁটা দেওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আর খোঁটা দিলে উপকার নিষ্ফল হয়ে যায়। প্রশ্ন করা যেতে পারে, উপকৃত ব্যক্তিরও তো কর্তব্য উপকারকারীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা। কেননা হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
ﻣَﻦْ ﺻَﻨَﻊَ ﺍِﻟَﻴْﻜُﻢْ ﻣَﻌْﺮُﻭْﻓًﺎ ﻓَﻜَﺎﻓِﺌُﻮْﻩُ ﻓَﺎِﻥْ ﻟَّﻢْ ﺗَﺠِﺪُﻭْﺍ ﻣَﺎ ﺗُﻜَﺎﻓِﺌُﻮْﻧَﻪ ﻓَﺎﺩْﻋُﻮْﺍ ﻟَﻪ.

‘যে ব্যক্তি তোমাদের কোনও উপকার করে, তোমরা তার বদলা দিও। যদি বদলা দেওয়ার মত কিছু না পাও, তার জন্য দুআ করো।’(সুনানে আবু দাউদ: ১৬৭২)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সবরকম জাহেরী ও বাতেনী ফিতনা থেকে রক্ষা করুন এবং সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দিন। আমিন।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *