১৩ বছর ধরে চলছে নির্মাণ, নকশা জটিলতা কাটেনি

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ২০১০-১৩ মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও নির্মাণকাজের অগ্রগতি এখনো ৫০ শতাংশের নিচে। অর্থায়নসহ বিভিন্ন জটিলতা কাটিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজে গতি এসেছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে কিছু অংশ চালুর পরিকল্পনাও করছে সরকার। তবে কাজে গতি এলেও নকশা নিয়ে জটিলতা রয়েছে একাধিক স্থানে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত সময়ে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ করা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে। প্রকল্পের সংশোধিত মেয়াদ রয়েছে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যত বিলম্ব হচ্ছে, ততই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বজনিত ক্ষতির পুরোটাই পড়ছে সরকারের কাঁধে। ২০১৩ সালে চালুর লক্ষ্য নিয়ে শুরু করা প্রকল্পটি ১০ বছর বা তারও বেশি সময় পর বাস্তবায়ন হলে এর প্রকৃত আর্থিক ও অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া নিয়েও বড় ধরনের আশঙ্কা রয়েছে।

অতীতে একাধিকবার নকশা নিয়ে জটিলতায় পড়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। কয়েক দফায় প্রকল্পটির নকশা সংশোধন করা হয়েছে। এখনো এক্সপ্রেসওয়েটি তৈরির ক্ষেত্রে একাধিক জায়গায় নকশা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় জটিলতা তৈরি হয়েছে পরিকল্পনাধীন একটি পাতাল মেট্রোরেলের গতিপথ নিয়ে।

পাতাল মেট্রোটি (এমআরটি-৫, সাউদার্ন রুট) নির্মাণ হবে ঢাকার গাবতলী থেকে আসাদগেট-রাসেল স্কয়ার-পান্থপথ-হাতিরঝিল-নিকেতন হয়ে আফতাবনগর পর্যন্ত। এ পাতাল মেট্রো কারওয়ান বাজারের এফডিসি রেলগেট এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচ দিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের (এফডিইই) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নকশা জটিলতার কারণে এফডিসি রেলগেট এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পাইল ওয়ার্ক বন্ধ হয়ে গেছে।

সৃষ্ট জটিলতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, এফডিসি রেলগেট এলাকায় মাটির নিচে হবে পাতাল মেট্রোরেল। আর ওপরে হবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। মাটির নিচে বড় জায়গাজুড়ে থাকবে পাতাল মেট্রোর টিউব। এজন্য এফডিসি রেলগেট এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের জন্য নতুন করে নকশা করতে হবে। তা করতে গেলে এখন এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাবে। সময়ও লাগবে বেশি। নির্মাণকাজও জটিল হয়ে পড়বে। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দ্বিতীয় অংশ (বনানী-মগবাজার) চালুর লক্ষ্যও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নকশা নিয়ে জটিলতা রয়েছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায়ও। নকশা অনুযায়ী, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি টোল প্লাজা তৈরি করা হবে। এ টোল প্লাজার নকশা সংশোধনের অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পাশাপাশি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি ওঠার এবং একটি নামার র্যাম্পের দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনারও পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বিদ্যমান নকশা অনুযায়ীই কমলাপুর এলাকায় কাজ করতে চান। বিষয়গুলো এখনো অমীমাংসিত রয়েছে।

জটিলতা রয়েছে হাতিরঝিল-বুয়েট লিংক র্যাম্প নিয়েও। র্যাম্পটির কাজ শুরু করা নিয়ে এখনো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কাছ থেকে অনুমতি পায়নি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি মগবাজার-কুতুবখালী অংশের পুরো জমি এখনো প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে টাকা কিংবা জনবল নয়, নকশাগত সমস্যাগুলোকে দায়ী করেছেন প্রকল্পের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অন্যতম বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান চায়না শ্যাংডং ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা ওয়াঙ ডেং পেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, প্রকল্পে টাকার কোনো সমস্যা নেই। আমাদের পর্যাপ্ত জনবল ও নির্মাণযন্ত্র আছে। কিন্তু নকশাসহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া জটিলতার কারণে আমাদের কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব এ জটিলতাগুলো দূর করা।

অন্যদিকে নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের এসব জটিলতার জন্য সঠিকভাবে সম্ভাবতা সমীক্ষা না করাকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হলে প্রকল্পটি আজ এত সমস্যার মধে পড়ত না। এখন নির্মাণকাজ যত বিলম্বিত হচ্ছে, ঠিকাদারকে তত ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। এখনো ঠিকাদারকে প্রকল্পের পুরো জমি বুঝিয়ে দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এর দায় কিন্তু ঠিকাদারের না, বাস্তবায়নকারী সংস্থা তথা সরকারের। নকশাগত জটিলতার পাশাপাশি নির্মাণকাজ বিলম্বিত হওয়ায় ট্রাফিক নিয়েও জটিলতায় পড়তে যাচ্ছে প্রকল্পটি। সবকিছু মিলিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যত দেরি হবে, আমরা এর যে আর্থিক রিটার্নের কথা বলছি, সেগুলোও তত কমে আসবে।

প্রতিদিন ৮০ হাজার যানবাহন চলাচলের উপযোগী করে তৈরি হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। বলা হচ্ছে, উড়ালসড়কটি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা তৈরি করবে। পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও ব্যবসাকেন্দ্রগুলোকে সংযুক্ত করবে। এজন্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার মূল এক্সপ্রেসওয়ের পাশাপাশি তৈরি করা হচ্ছে ৩১টি র্যাম্প। এসব র্যাম্প দিয়ে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যক ও ব্যবসাকেন্দ্র থেকে যানবাহন এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে ও নামতে পারবে। এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণ ব্যয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। থাইল্যান্ডভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (ইতাল-থাই) এটির মূল নির্মাণকারী। চীনের শ্যাংডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল করপোরেশন গ্রুপ লিমিটেড ও সিনো-হাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডও আছে নির্মাণ অংশীদার হিসেবে। নির্মাণ-পরবর্তী ২৫ বছর টোল আদায়ের মাধ্যমে মুনাফাসহ নির্মাণ ব্যয় তুলে আনবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এরপর হস্তান্তর করা হবে বাংলাদেশকে।

প্রকল্পের কর্মকর্তারা নকশাসহ বিভিন্ন জটিলতার কারণে নির্ধারিত সময়ে নির্মাণকাজ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা করলেও সেতু বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মনজুর হোসেন বলছেন ভিন্ন কথা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, রেলওয়ের সঙ্গে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করছি। একইভাবে অন্য যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোও সমাধান করা হচ্ছে। নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যেই ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হবে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *