সুসময় থেকে শৈথিল্যের পথে যুক্তরাজ্য-চীন সম্পর্ক

নিকট অতীতেই যুক্তরাজ্যের ওপর নিঃসংকোচে নির্ভর করতে পারত চীন। আন্তর্জাতিক যেকোনো উদ্যোগ বা সংবেদনশীল খাতের বিনিয়োগে বেইজিংয়ের পাশে থাকত লন্ডন। কিন্তু উইঘুর নিপীড়ন এবং হংকংয়ে বিতর্কিত নিরাপত্তা আইন নিয়ে দুই মিত্রের সম্পর্কের উষ্ণতা অনেক আগেই মিইয়ে গেছে। হংকং ও উইঘুর ইস্যুকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু দাবি করে নাক গলানো থেকে বিরত থাকতে লন্ডনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে বেইজিং। কিন্তু হংকংয়ের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিবেচনায় তা অবজ্ঞা করা প্রায় অসম্ভবই ব্রিটেনের পক্ষে। টাইমস অব লন্ডন গত বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে জানায়, গত ৩১ জানুয়ারি হংকংবাসীর জন্য ব্রিটেনের দরজা উন্মুক্ত করার দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার হংকং বাসিন্দা ব্রিটিশ নাগরিকত্বের আবেদন করেছে। যুক্তরাজ্যের এ নাগরিকত্ব কর্মসূচি তাদের জন্য প্রযোজ্য, যারা ব্রিটিশ ন্যাশনাল ওভারসিস (বিএনও) মর্যাদা অর্জন করেছে বা অর্জন করার যোগ্য। খবর নিক্কেই।

গত বছরের জুনে বেইজিং কর্তৃক হংকংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা আইন কার্যকরের পর যুক্তরাজ্য পাঁচ বছর মেয়াদি ভিসা প্রদান শুরু করে এবং তার ধারাবাহিকতায় বিএনও মর্যাদার ঘোষণা দেয়। এদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিএনও ভিসাকে স্বীকৃতি না দিয়ে পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

বছর কয়েক আগেই যুক্তরাজ্য ও চীনের সম্পর্ক স্বর্ণযুগে রয়েছে বলে বলা হতো। ২০১৫ সালে বেইজিং নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে (এআইআইবি) যুক্ত হওয়া জি৭ভুক্ত একমাত্র দেশ ছিল যুক্তরাজ্য। একই সঙ্গে ব্রিটিশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছিল চীনা উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে ব্রিটিশ স্টিল কিনে নেয় চীনের জিঙ্গে গ্রুপ। এগুলোর ফলে উভয় দেশের সম্পর্ক আরো উষ্ণ হবে এমনটাই আশা করছিল সংশ্লিষ্টরা।

চীনের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয় করোনা মহামারীর শুরুতে চীনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার বিষয়টিতে। হংকংয়ে নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়নের পর আনুষ্ঠানিকভাবে তা তিক্ত রূপ ধারণ করে। কভিড-১৯ মহামারীতে ইউরোপের সর্বোচ্চ প্রাণহানি হয় যুক্তরাজ্যে। এছাড়া ব্রেক্সিটের ফলে এরই মধ্যে নড়বড়ে হয়ে পড়া অর্থনীতিতে আরো বিপর্যয় নিয়ে আসে করোনা। ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কর্তৃক সিজিটিএনের সম্প্রচার লাইসেন্স বাতিলের পর তিক্ততা চরমে পৌঁছায়। ব্রিটিশ নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠানটির অভিযোগ, সিজিটিএনের সব ধরনের সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত আসে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি থেকে।

লন্ডনভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায়, সম্প্রতি তিনজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা তিনটি পৃথক গণমাধ্যমের হয়ে কাজ করছিল। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজকে নিষিদ্ধ করে চীন। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং উইঘুরদের ওপর নিয়মতান্ত্রিক নিপীড়ন নিয়ে বিবিসির সংবাদ প্রকাশে উষ্মা প্রকাশ করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ।

বেইজিংয়ের প্রতি লন্ডনের শক্ত অবস্থানের পেছনে চীনের ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রভাবে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির মনোভাব দায়ী। রক্ষণশীল দলটি ঐতিহ্যগতভাবেই মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলে আসছে। হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন দুর্বল হওয়া এবং উইঘুরদের জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত করার বিষয়টিতে চোখ-কান বন্ধ রাখতে পারেনি তারা।

চলতি মাসের শুরুতে হাউজ অব লর্ডসে একটি আইনের সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছে। কোনো বাণিজ্য অংশীদারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উঠলে তার সঙ্গে চুক্তি পুনর্বিবেচনার এখতিয়ার পাবেন উচ্চ আদালত। আইনটি অনুমোদন পেলে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) বাণিজ্য চুক্তিতে প্রবেশে বাধার মুখোমুখি হবে চীন।

আবার চীনের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়বে যুক্তরাজ্য। করোনা মহামারীতে গত বছর বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলো সংকোচনের মধ্যে গেলেও প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে চীনসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি অর্থনীতি। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় চলতি বছর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে চীন। ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি চাঙ্গায় বেইজিংয়ের সঙ্গে শিগগিরই সমঝোতার পথে এগোতে হবে লন্ডনকে। স্বর্ণযুগে না ফিরলেও বেইজিং-লন্ডনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক কীভাবে মোটামুটি স্বাভাবিক করা যায় এদিকে দৃষ্টি ব্যবসায়ীদের।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *