সীমান্তকেন্দ্রিক অপরাধে ব্যবহার করা হচ্ছে উদ্বাস্তু শিবিরের রোহিঙ্গাদের

কক্সবাজারের উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলোয় বর্তমানে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাস। কর্মহীন এসব রোহিঙ্গা অর্থের প্রয়োজনে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পথে মাদক, অস্ত্র এমনকি স্বর্ণ চোরাচালানের কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের। এসব কাজ করতে গিয়ে কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে, কখনো সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়ছে উদ্বাস্তু শিবিরের রোহিঙ্গারা। কখনোবা অবৈধ এসব কাজের অর্থ ভাগাভাগি নিয়েও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে তারা। হচ্ছে খুনোখুনিও। এতে মাদক ও সন্ত্রাস রোধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো ফিকে হয়ে আসছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে তাদের অপরাধকর্মে সম্পৃক্ত করা বিশেষ মহল। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারলে তাদের মধ্যে অপরাধ সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকবে।

সীমান্ত দিয়ে অবৈধ মাদক, অস্ত্র ও স্বর্ণ চোরাচালান করতে গত তিন মাসে শুধু বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) হাতেই আটক হয়েছে কক্সবাজারের উদ্বাস্তু শিবিরের অন্তত ২০ জন রোহিঙ্গা। সর্বোচ্চ আটজন কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের। এ ক্যাম্পে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার বাস। এ কারণেই ক্যাম্পটির নিয়ন্ত্রণ নিতে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিশেষ তত্পরতা চালিয়ে আসছে। আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে ক্যাম্পটির অন্তত ১০ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময়ে খুন হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধেও সবচেয়ে বেশি এ ক্যাম্পের সদস্যরা নিহত হয়।

বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার একটি সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুমধুম ইউনিয়ন। এর দক্ষিণ ও পূর্বে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের অবস্থান। চোরাকারবারিদের কাছে এ গ্রাম খুবই পরিচিত। এ সীমান্ত দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা চোরাচালান হয়ে থাকে। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র, গুলি ও স্বর্ণ চোরাচালান হয়ে থাকে এ পথেই। এ ধরনের অপরাধ রোধে ৬৪ বর্গকিলোমিটার এলাকার এ গ্রামজুড়ে সার্বক্ষণিক তত্পরতা রয়েছে বিজিবির।

সবশেষ ঘুমধুম গ্রামের রেজুআমতলী আমবাগান থেকে ৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে দুই লাখ পিস ইয়াবাসহ ছয়জনকে আটক করে বিজিবি। এরমধ্যে পাঁচজনই কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১-এর বাসিন্দা। ইয়াবা পাচারের ঘটনায় এদের নেতৃত্বে ছিলেন কক্সবাজার উখিয়ার থ্যাইংখালী গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন। তিনিও বিজিবির হাতে আটক হন।

কক্সবাজার ব্যাটালিয়ন (৩৪ বিজিবি) পরিচালক আলী হায়দার আজাদ আহমেদ জানান, রেজুআমতলী বিওপির একটি বিশেষ আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে যে, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ ইয়াবা নিয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। এমন আগাম তথ্যের ভিত্তিতে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় প্রায় ৬ কোটি টাকার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, দুই বছরে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৩৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। এছাড়া নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে আরো ৪৩ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিহত হয়। এ দুই বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ৪৭১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাদকসংক্রান্ত মামলা। তাছাড়া মানব পাচারের অভিযোগে চারটি মামলাসহ অস্ত্র, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, নারী নির্যাতন, অপহরণ ও পুলিশের ওপর হামলার মামলা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, ক্যাম্পভিত্তিক মাদক ব্যবসা রোহিঙ্গা অর্থের একটি বড় উৎস। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা ক্যাম্পে মজুদ করে এখান থেকেই বণ্টন করা হয়। পাশাপাশি তাদের দিয়ে টাকার বিনিময়ে মাদক, অস্ত্র ও ইয়াবার চালান দেশের অভ্যন্তরে এনে থাকে স্থানীয় এক শ্রেণীর প্রভাবশালীরা। গত ২ অক্টোবর কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে পালংখালীতে একটি অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়ে অভিযান চালায় র্যাব। সেখান থেকে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র, দুই রাউন্ড গুলি এবং অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। ওই সপ্তাহেই কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত আটজন মারা যায়। আহত হয় অর্ধশতাধিক।

শুধু ইয়াবা চোরাচালানের ক্ষেত্রেই নয়, রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে অবৈধ পথে স্বর্ণও আসতে শুরু করেছে। ১ নভেম্বর রাতে বিজিবির ঘুমধুম বিওপির সদস্যরা কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার ৫ নং পালংখালী ইউপির কুড়ারপাড়া এশিয়ান হাইওয়ে থেকে মো. কলিম নামের একজন রোহিঙ্গার হেফাজত থেকে ৪৭১ ভরি ৯ আনা ৪ রতি ওজনের ৩১টি স্বর্ণের বার ও বিভিন্ন ধরনের স্বর্ণালংকার উদ্ধার করেন। কলিম বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮, ব্লক-বি/৪৭-এর কবির আহম্মেদের ছেলে। আটকের পর তাকে পুলিশ হেফাজতে দেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে কলিম পুলিশকে জানায়, টাকার বিনিময়ে তিনি মিয়ানমার থেকে অবৈধ পথে স্বর্ণ, মাদক ও অস্ত্রের চালান ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসার কাজটি করতেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমডোর (অব.) ইসহাক ইলাহী চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, হতাশা ও আর্থিক সংকট থেকেই মূলত রোহিঙ্গারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের নানা অপরাধকর্মে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তাদের ব্যবহার করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা মাদক, অস্ত্র ও স্বর্ণের চোরাচালান করছে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে প্রথমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় সুপারভিশন বাড়াতে হবে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *