টানা কয়েক দশক প্রযুক্তি শিল্পের কেন্দ্রস্থল ছিল সিলিকন ভ্যালি। ১৯৩৮ সালে এ প্রযুক্তি হাবের যাত্রা, যখন বিল হিউলেট ও ডেভিড প্যাকার্ড পালো আলতোর একটি গ্যারেজে টুকটাক কাজ শুরু করেন। তাদের হাত ধরেই বিখ্যাত কম্পিউটার হার্ডওয়্যার কোম্পানি হিউলেট প্যাকার্ড (এইচপি) প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে এ শিল্পাঞ্চলের অবস্থান।
একসময়ের স্টার্টআপ বা উদ্যোক্তাদের এ স্বপ্নভূমি বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। হাই প্রোফাইল প্রযুক্তি বিনিয়োগকারী এবং এক্সিকিউটিভদের একটি বড় দল সানফ্রান্সিসকো ছেড়ে যাচ্ছেন। এ কারণে একটি প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে, তাহলে কি সিলিকন ভ্যালি যুগের অবসান হচ্ছে?
চলতি মাসে সিলিকন ভ্যালির দীর্ঘদিনের জায়ান্ট ওরাকল জানিয়েছিল, ক্যালিফোর্নিয়ার চার দশকেরও বেশি সময় পর সংস্থাটি সদর দপ্তর টেক্সাসের অস্টিনে সরিয়ে নিচ্ছে। আবার যাদের হাত ধরে সিলিকন ভ্যালির যাত্রা শুরু হয়েছিল, সে হিউলেট প্যাকার্ড এন্টারপ্রাইজের (এইচপিই) সদর দপ্তরও টেক্সাসের হিউস্টনে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এছাড়া চলতি মাসে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের সিইও ইলোন মাস্ক জানান, চলতি বছরের শুরুর দিকে বেল এয়ারের বাড়ি বিক্রি করে দেয়ার পরই তিনি টেক্সাসে চলে গেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা টেসলাও স্থান পরিবর্তন করতে পারে।
একসময় ছোট ছোট উদ্যোগ কুঁড়ির মতোই ফুল হয়ে বিকশিত হতো সিলিকন ভ্যালিতে। অথচ প্রযুক্তি হাব হিসেবে সিলিকন ভ্যালির আধিপত্য কমেই চলেছে। এটির পরিবর্তে টেক্সাস ও ফ্লোরিডাসহ অন্যান্য শহরে ঘাঁটি করছেন উদ্যোক্তারা।
সিলিকন ভ্যালির মৃত্যু সংবাদ অনেক আগেই লেখা হয়েছিল। ১৯৭০ দশকের শুরুর দিকে সামরিক ব্যয় হ্রাসের ফলে ক্যালিফোর্নিয়ার বড় সংস্থাগুলো কর্মী ছাঁটাইয়ে নেমে পড়ে এবং উদ্যোক্তাদের মূলধন ছোট হয়ে আসে। এরপর ১৯৮০-এর দশকে কম্পিউটার বাজারের আগমন এবং অ্যাপল ও আতারির মতো জায়ান্ট সংস্থাগুলোর হাত ধরে সিলিকন ভ্যালি আবারো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরের দশকে ডেস্কটপ কম্পিউটার বাজারের উত্থান এবং ইন্টারনেটের বাণিজ্যিকীকরণ আগের চেয়ে ভ্যালির গতি বাড়িয়ে তোলে। সে সময় নেটস্কেপ, ইয়াহু ও ইবেয়ের মতো সংস্থাগুলো সিলিকন ভ্যালির আরো সুনাম বাড়িয়ে দেয়।
এগুলোর পাশাপাশি উপসাগরীয় অঞ্চলের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে অভিযোগগুলো জোরালো হতে থাকে। ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে হাউজিংয়ের দাম কিছু প্রযুক্তি সংস্থাকে অস্টিনসহ ছোট ছোট শহরে স্থানান্তরিত হতে প্ররোচিত করেছিল। করপোরেট নেতারা ক্যালিফোর্নিয়ার উচ্চ করের বিষয়েও অভিযোগ করে চলেছেন এবং অঙ্গরাজ্যটি ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু সিলিকন ভ্যালি সম্পর্কিত বড় বিনিয়োগ সংস্থাগুলোকে এখানে আটকে রাখতে সহায়তা করেছে। যদিও এ লোভনীয় সুযোগ সাম্প্রতিক সময়েও ছিল।
কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারী সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। যখন বহু মানুষ অফিস থেকে বাসা থেকে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি সংস্থা জানিয়েছে, মহামারী শেষেও তারা কিছু কর্মীকে স্থায়ীভাবে বাড়ি থেকে কাজ করার বিকল্প দেবে। যেমন গুগলের নমনীয় প্রবণতা অন্য সংস্থাগুলোও অনুসরণ করছে। ‘নমনীয় ওয়ার্কউইক’-এর আওতায় অফিসে তিনদিন এবং বাড়ি থেকে দুইদিন কাজের সুযোগ দিচ্ছে সংস্থাগুলো। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য-শিল্পের ১৬ শতাংশ কর্মী দূর থেকে কাজ করছেন। এতে করে অফিস কেন্দ্রিক চাপ কমে যাওয়া সংস্থাগুলোকে পালানোর পথ সহজ করে দিয়েছে।
টেক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে সিলিকন ভ্যালি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিগত দশকের সবচেয়ে সফল স্টার্টআপগুলোর কয়েকটি সিলিকন ভ্যালির বাইরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নতুন সানফ্রান্সিসকো আইনগুলোর পর উদ্যোক্তারা অভিযোগ করে আসছেন, ক্যালিফোর্নিয়া মানুষ ও ব্যবসায়ের জন্য আশ্রয়হীন হয়ে উঠেছে।
এক্ষেত্রে অস্টিন ও মিয়ামিতে নামমাত্র আয়কর টেক উদ্যোক্তাদের আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত করেছে। যদিও এখানে করের হিসাবের চেয়েও অনেক বেশিকিছু রয়েছে। কারণ টেক্সাস অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে একটি হাই-টেক অঙ্গরাজ্য, নাসা মিশন নিয়ন্ত্রণ, বড় বগ ইলেকট্রনিকস ও কম্পিউটার সংস্থা এবং গবেষণা কেন্দ্রগুলোর আবাসস্থল। ডেল কম্পিউটার এবং কয়েক ডজন সংস্থার দীর্ঘদিনের আবাস অস্টিন একটি রাতারাতি সাফল্যের গল্প, যা ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে টেক হাব হিসেবে দীর্ঘ ইতিহাস না থাকলেও মিয়ামি এরই মধ্যে বড় বড় টেক সংস্থার সদর দপ্তরে পরিণত হয়েছে।
তবে একটি বিষয় বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে সিলিকন ভ্যালির আধিপত্যের সবচেয়ে হুমকি কেবল দেশের মধ্য থেকেই আসছে না; যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকেও আসছে। প্রযুক্তি বিনিয়োগে বিশ্বায়ন আলিবাবা, হুয়াওয়ে ও বাইটডান্সের মতো চীনা সুপারস্টারগুলোকে সামনের কাতারে নিয়ে এসেছে। এ কারণে টেক স্টার্টআপগুলো সিলিকন ভ্যালির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এখন পুরো বিশ্বে সমৃদ্ধ হচ্ছে। সর্বোপরি প্রযুক্তির বিকাশে উদ্যোক্তাদের এখন সিলিকন ভ্যালির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। এমনকি তাদের যুক্তরাষ্ট্রেও যাওয়ার দরকার নেই। বিশ্বায়ন এখন পুরো বিশ্বকে সিলিকন ভ্যালিতে পরিণত করছে। নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে