সিনেমাপ্রেমী দুই তরুণ নির্মাতার গল্প

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ১৪তম আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব। পুরস্কার বিতরণের মধ্য দিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি উৎসবের পর্দা ওঠে। এ বছর আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশী শিশু নির্মাতাদের প্রতিযোগিতা বিভাগে যে চলচ্চিত্রগুলো পুরস্কার পেয়েছে তার মধ্যে ‘টেনর’ একটি। অন্যদিকে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে ‘লটারি’ স্বল্পদৈর্ঘ্যটি। ‘টেনর’ নির্মাণ করেছেন তরুণ নির্মাতা রাহী আব্দুল্লাহ ও ‘লটারি’ কেএম কনক। গতকাল কথা হয় এ দুই তরুণ নির্মাতার সঙ্গে।

দুজনই চলচ্চিত্রপাগল। আর চলচ্চিত্রকে ভালোবেসেই নির্মাতা হিসেবে তাদের যাত্রা। কেএম কনক গত বছর ফেব্রুয়ারিতে নির্মাণ করেন লটারি। এটাই তার প্রথম প্রডাকশন। স্টেশনে বেড়ে ওঠা দুই বন্ধুর গল্প নিয়েই মূলত লটারির কাহিনী। ১৪তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্যটি বিশেষ পুরস্কার লাভ করে। এমন প্রাপ্তিতে বেশ আনন্দিত তরুণ এ নির্মাতা। পুরস্কার পাওয়া নিয়ে কনক বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে। পুরস্কারপ্রাপ্তিটা আগামী দিনে কাজের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জোগাবে।’

আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে এবারই প্রথম অংশ নিয়েছেন কনক। এ উৎসবে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ অভিজ্ঞতাটা ছিল দারুণ। স্টেজে যখন কিছু বলার জন্য আমার নাম ঘোষণা করা হচ্ছিল তখন অনেকে বুঝতে পারেননি, কিন্তু যখন লটারি বলেছে তখন চারদিক থেকে একটা আওয়াজ কানে আসে। সেটা ছিল অনেক আনন্দের। সবাই লটারি লটারি করছিল। সব মিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে।’ উৎসবে অংশ নেয়ার একটি মজার অভিজ্ঞতা বিনিময় করে কনক বললেন, ‘পুরস্কার পাওয়ার পর যখন আমরা সবাই আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন একজন আন্টি এসে বলছিলেন, ‘খুব খুশি হয়েছি। আপনি থামবেন না। সামনে এগিয়ে যান।’ তখন তাত্ক্ষণিকভাবে বলে উঠি, ‘আমি থেমে থাকার জন্য আসিনি।’ উৎসবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পাশাপাশি বিভিন্ন ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে দেশের স্বনামধন্য নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। এ অভিজ্ঞতাগুলোকে আগামী দিনের সম্পদ মনে করছেন কনক। ‘লটারি’ এর আগে বিভিন্ন উৎসবে অংশ নিয়েছে। স্বল্পদৈর্ঘ্যটি গত বছর তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে।

ছোটবেলা থেকেই নাটক দেখতে পছন্দ করতেন কেএম কনক। নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে তিনি দীর্ঘদিন প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন নির্মাতা রেদওয়ান রনির সঙ্গে। বলা যায় এখানেই তার হাতেখড়ি। এরপর চিলেকোঠার ব্যানারে কাঠবিড়ালী ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এ ধারাবাহিকতায় আবারো কাঠবিড়ালী টিমের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে ‘রক্তজবা’র কাজ করছেন। কিছুদিন আগে কনক মডেল, অভিনেত্রী, আইনজীবী জান্নাতুল ফেরদৌস পিয়াকে নিয়ে একটি বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেছেন। ভবিষ্যতে নির্মাতা হিসেবেই পথ চলতে চান কনক। আর সে স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে চলেছেন আগামীর পথে।

ফটোগ্রাফি দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে যাত্রা রাহী আব্দুল্লাহর। ২০১৫ সালের কথা। একটি ক্যামেরা দিয়ে এক্সপেরিমেন্টমূলক কাজ শুরু করেন। এরপর ২০১৬ সালে ‘ইয়ুথ কনশাস’ ও ২০২০ সালে নির্মাণ করেন ‘মাদারল্যান্ড’ নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য। একই বছর জুলাইয়ে শুরু করেন টেনরের কাজ। শুটিং শেষ হয় অক্টোবরে।

এরপর ১৪তম আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে জমা দেন ছবিটি। ‘টেনর’ কলকাতার হট্টমেলা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও অংশ নিয়েছে। এক শিশুর লুকানো বেদনার সেলুলয়েড গল্পই ‘টেনর’ নামের স্বল্পদৈর্ঘ্যটির মূল উপজীব্য। আহাদ নামের এক শিশুর বাবা দালালের হাত ধরে পাড়ি জমিয়েছেন অন্য এক দেশে। সেই শিশুর ফুটবল পাওয়ার ইচ্ছাকে কেন্দ্র করে একটি জনপদের অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দেয়া, প্রবাসী ও তার পরিবারের বেদনা, কষ্ট, সমাজের নানাবিধ হয়রানি নিয়েই কাহিনী এগিয়েছে এ চলচ্চিত্রের।

রাহীও এবারই প্রথম চিলড্রেন’স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশ নেন। উৎসবে অংশগ্রহণ ও পুরস্কারপ্রাপ্তিকে সেরা অভিজ্ঞতা বলে মনে করছেন রাহী। তিনি বলেন, ‘উৎসবে অংশগ্রহণ করে এক পর্যায়ে মনে হয়েছে পুরস্কার পাওয়াটা বড় নয়, বরং উৎসবে সাতদিন সবার সঙ্গে কাটানোটাই মূল আনন্দের। এ ক’দিনে অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি, বুঝেছি। সবাই আনন্দ, হই-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে সময় কাটিয়েছি।’

রাহীর ‘মাদারল্যান্ড’ স্বল্পদৈর্ঘ্যটিও কলকাতা হট্টমেলা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ারই বা ইচ্ছা জাগল কেন? এমন প্রশ্নে রাহীর উত্তর, ‘নির্মাণ বিষয়টির মধ্যে এক ধরনের মজা আছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। আর আমি যেহেতু ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, ফলে এ কাজ আমার সঙ্গে যায়। এ ভাবনা থেকেই আসলে নির্মাণের প্রতি “প্যাশন” তৈরি হয়।’ রাহী বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন। সিনেমা নিয়েও থেমে নেই তার স্বপ্ন। আগামীতে চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে চান। নতুন একটি পরিকল্পনার কথা জানিয়ে রাহী বলেন, চিলড্রেন’স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যারা অফিসিয়ালি সিলেকশন পেয়েছি, তাদের সবার একটি অ্যান্থলজি মুভি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *