সিনহাকে হত্যায় প্রদীপ-লিয়াকতের ৫ লাখ টাকার মিশন ছিল: আইনজীবী

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপ-লিয়াকতের ফাঁসি হতে পারে বলে জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। অন্যদিকে, সিনহাকে হত্যা করতে ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের ৫ লাখ টাকার একটি মিশন ছিল বলে জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।

সিনহা হত্যা মামলার রায়ের আদেশ ৩১ জানুয়ারি নির্ধারণ করেছে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

এই আলোচিত মামলার সার্বিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছেন কক্সবাজারের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তিনি সিনহা হত্যা মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবীও। এছাড়া, মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে রয়েছেন অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।

মামলাটি নিয়ে রবিবার এই দুই আইনজীবী বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদকের কাছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার আগে তাকে ডাকাত বলে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা হয়। এটি ৫ লাখ টাকার মিশন ছিল ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের।সুনামগঞ্জে স্বেচ্ছায় ৩২ আসামির আত্মসমর্পণ[১] শাবির আন্দোলনে অসুস্থ হওয়া শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যয়ভার নিলেন প্রধানমন্ত্রী[১] পাকিস্তানের জয়ে যারা বাজি ফাটান, তারা ভারতীয় নন, গৌতম গম্ভীরের তীব্র নিন্দা

অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেছেন- ‘মামলার সাক্ষী, জেরা, যুক্তিতর্ক ও আসামিদের জবানবন্দি এবং বিভিন্ন প্রমাণের ভিত্তিতে মামলার ১নং আসামি বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও ২নং আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ও বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। অন্যান্য আসামিদের যাবজ্জীবন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হতে পারে।’

জাহাঙ্গীর বলেন, ‘উক্ত মামলায় আমি প্রথম থেকে বাদী পক্ষের আইনজীবী হিসাবে রয়েছি। এ মামলায় ৬৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা ও জেরা করা হয়। এদের মধ্যে ৮জন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী রয়েছে। এই ৮জন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আদালতে বলেছেন, মামলার ১নং আসামি লিয়াকত আলী মেজর সিনহাকে পরপর ৪টি গুলি করেছেন। মেজর সিনহা আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে গেলে লিয়াকত বিভিন্ন জায়গা টেলিফোন করে। কিছুক্ষণ পর ওসি প্রদীপ টেকনাফ থেকে এসে পা দিয়ে মেজর সিনহাকে নেড়ে দেখে মারা গেছে কিনা। তখন মেজর সিনহা পানি পানি করছিল। প্রদীপ বুটজুতা দিয়ে সিনহার বাম পাশে গলায় চেপে ধরে। তখন মেজর সিনহা ঘটনাস্থলে মারা যায়। যা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও উল্লেখ রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি ৪৩বছর আইনজীবী পেশায় রয়েছি। এতে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে উক্ত মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আলামতের ওপর ভিত্তি করে আদালত যদি ৮ সাক্ষীদের মধ্যে ১জনকেও বিশ্বাস করেন তাহলে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ এবং বরখাস্ত এসআই লিয়াকতের ফাঁসি হওয়া উচিত’।

অপরদিকে, সিনহা হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগে সহযোগী সিফাতকে নিয়ে মেজর সিনহা টেকনাফের বাহারছড়া নারিচবনিয়া মুইন্যাপাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে গিয়েছিল। তখন ওসি প্রদীপ-লিয়াকত ডাকাত বলে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। এ সময় ওই এলাকায় মাথাভাঙ্গা মসজিদের ইমাম হাফেজ জহিরুল ইসলাম তাদের সে পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন। এ সময় পুলিশের সোর্স আয়াজ, নুরুল আমিন ও নিজাম উদ্দিন ওই মসজিদের ইমামকে ওসি প্রদীপের কথা বলে ৫লাখ টাকার অফার দেয়। কিন্তু, ইমাম হাফেজ জহিরুল ইসলাম তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।’

ফরিদ বলেন, ‘ওসি প্রদীপ ও তার ৩ সোর্স পূর্ব পরিকল্পিতভাবে মেজর সিনহাকে হত্যা করেছে। ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতের পৃথক জিডিতেও হত্যার পরিকল্পনার কথা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। এটি আমরা আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি। আমরা আশা করি আদালত অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেবেন।’

অ্যাডভোকেট ফরিদ আলমের ভাষ্যমতে, ‘ওসি প্রদীপ টেকনাফে চাঁদাবাজি, ক্রসফায়ার, গুমসহ নানারকম অপরাধ করে যাচ্ছিল। মেজর সিনহার ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে কক্সবাজারের উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে যখন টেকনাফে ভিডিও চিত্র ধারণ করছিলেন। তখন স্থানীয় ভুক্তভোগী মানুষ ওসি প্রদীপের অপরাধের বিষয়ে মেজর সিনহাকে প্রতিবেদন করতে অনুরোধ করেন। এ সময় মেজর সিনহা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে ওসি প্রদীপের বিভিন্ন অপরাধ নিয়ে ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার নেয়া শুরু করে। ওসি প্রদীপ বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এরপর তাকে হত্যার পরিকল্পনার নীল নকশা তৈরি করে ওসি প্রদীপ।’

উল্লেখ্য, গত ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর বাজারের কাছে এপিবিএন পুলিশ চেকপোস্টে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকতের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় ওই বছরের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহের আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটির তদন্তভার দেন কক্সবাজারের র‌্যাব-১৫কে।

২০২০ সালের ৬ আগস্ট ওসি প্রদীপ দাশ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ মামলার আসামি সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় তিন বাসিন্দা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য ও ওসি প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের আদালতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসে। পাশাপাশি পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তার নিহত হওয়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে অতিরিক্ত ডিআইজি এবং লে কর্নেল মর্যাদার একজন সেনা কর্মকর্তাকে সদস্য করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে।

এ মামলায় চার মাসের বেশি সময় তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষীসহ অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের তথ্যমতে, গত ২০২১ সালের ২৭ জুন জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলার চার্জ গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। সর্বশেষে ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলায় উভয় পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের শেষ দিনে আদালত ৩১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *