সংক্রমণের তীব্রতায় ইউরোপে আবার ফিরছে লকডাউন

নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে প্রায় দুই বছর উত্থান-পতনের মধ্যেই জীবনযাপন করছে সারা বিশ্বের মানুষ। কখনো এক দেশে পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে তো হঠাৎই অন্য দেশে খারাপ হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় ঠিকঠাক ভবিষ্যৎ পূর্বানুমান করা ও সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়াও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে কভিড-১৯-এর তাণ্ডব কিছুটা স্তিমিত হয়েছে, এখন এটি ঘুরেছে ইউরোপের দিকে। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের ঠাণ্ডা আবহাওয়া আরো বেশি ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করছে ভাইরাসটিকে। অবস্থা কোন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাবে, সেই আশঙ্কায় শুরু থেকেই নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে ইউরোপের দেশগুলো। কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকাদান কর্মসূচি তো চলছেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লকডাউনের দিকেও নতুন করে ঝুঁকতে যাচ্ছে কোনো কোনো দেশ।

এরই মধ্যে ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, আগামী সোমবার থেকে শুরু হয়ে দেশটিতে ২০ দিন লকডাউন চলবে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে আগামী ১২ ডিসেম্বর।

সম্প্রতি অস্ট্রিয়ায় কভিড-১৯ সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছে। পাশাপাশি টিকাদানের সংখ্যাও আশাব্যঞ্জক নয়। এমন পরিস্থিতিতে লকডাউনের মতো সমাধানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে অস্ট্রিয়াকে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, অস্ট্রিয়ায় ১ লাখে ৯৯০ জনেরও বেশি মানুষ নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। দেশটির মাত্র ৬৫ শতাংশ মানুষ কভিড-১৯ টিকার পূর্ণাঙ্গ ডোজ পেয়েছে। সংখ্যাটা ইউরোপের মধ্যে সর্বনিম্ন।

নভেল করোনাভাইরাসের পুনরুত্থান ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রথম দেশ হিসেবে অস্ট্রিয়ায় লকডাউন দেয়া হলো। কেবল অস্ট্রিয়াতেই নয়, ইউরোপে অনেক দেশেই বাড়ছে সংক্রমণ। ফলে নতুন করে অনেক দেশেই লকডাউন দেয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু করেছে।

পশ্চিম ইউরোপের ৬০ শতাংশ মানুষ কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকার আওতায় চলে এসেছে, কিন্তু পূর্ব ইউরোপে টিকা গ্রহণের হার অর্ধেক। ফলে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া বিশ্ব

স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে মৃত্যুর হার বেড়েছে ৫ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপই বিশ্বের একমাত্র অঞ্চল হয়ে উঠেছে, যেখানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বাড়ল।

ডব্লিউএইচওর ইউরোপের আঞ্চলিক পরিচালক হানস ক্লুগ সতর্কবার্তা জানিয়ে বলেছেন, সামনে কঠিন শীত অপেক্ষা করছে। এভাবে নভেল করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পেছনে কম টিকা বিতরণ ও সুরক্ষা পদক্ষেপ কমিয়ে ফেলাই মূল কারণ বলে মনে করেন তিনি।

ইউরোপের পরিস্থিতি বোঝার জন্য স্লোভাকিয়ার দিকে ফিরলে দেখা যাবে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হেজার যারা কভিড-১৯ টিকা নেননি, তাদের জন্য সোমবার থেকে লকডাউন ঘোষণা করেছেন। শুধু কভিড-১৯ পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ দেখাতে পারলেই কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারবেন। এর পরও পরবর্তী তিন সপ্তাহে পরিস্থিতি ঠিক না হলে আরো বড় নিষেধাজ্ঞা জারি করতে সরকার প্রস্তুত আছে বলেই জানান তিনি।

৫০ লাখের বেশি জনসংখ্যার দেশটিতে টিকা গ্রহণ করেছে মাত্র ৪৫ শতাংশ। একদিনে সেখানে এ ভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে ৮ হাজার ৩৪২ জন। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, কভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৮১ শতাংশই পূর্ণাঙ্গ টিকা নেয়নি।

চেক প্রজাতন্ত্রেও বেশকিছু ক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহণ সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। দেশটিতে নতুন করে সংক্রমণের সর্বোচ্চ হার দেখা গেছে। গত সাতদিনে সেখানে নভেল করোনাভাইরাসে নতুন করে সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮১৩ জনে, আগের সপ্তাহে যেটা ছিল ৫৫৮ জন। নতুন সরকারি নিয়ম অনুসারে ২২ নভেম্বর থেকে যারা টিকা গ্রহণ করেনি, তারা কোনো জনসমাগমে অংশ নিতে পারবে না, বারে বা রেস্টুরেন্টে যেতে পারবে না। হোটেলে অবস্থান করতে পারবে শুধু কভিড-১৯ পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে।

গত সপ্তাহ শেষে আংশিক লকডাউন ঘোষণা করেছিল নেদারল্যান্ডসও। এখনো চলমান রয়েছে তিন সপ্তাহব্যাপী সেই লকডাউন। দেশটির পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউট মঙ্গলবার বলেছে, দেশটিতে কভিড-১৯ সংক্রমণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৪ শতাংশে, যা নভেল করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ। সেখানকার মোট জনসংখ্যার ৮৪ শতাংশ পূর্ণবয়স্কই টিকা নিয়েছেন। কিন্তু উদ্বেগের কথা হলো, এবারে বেশি সংক্রমিত হচ্ছে ৪-১২ বছর বয়সী শিশুরা, যারা এখনো টিকার আওতায় আসার অপেক্ষায় রয়েছে।

যেসব জায়গায় নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার বেশি, সেসব জায়গায় যারা টিকা নেননি, তাদের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করতে একমত জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলও। বৃহস্পতিবার একদিনেই জার্মানিতে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয় ৬৫ হাজার মানুষ। যদিও কর্মকর্তাদের মতে সঠিক সংখ্যাটা আরো বেশি। এরপর গতকাল বাস, ট্রেন ও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার পেতে টিকা, নেগেটিভ ফলাফল বা সুস্থ হয়ে ওঠার সনদ প্রদানের আদেশ দেয় দেশটির সংসদ।

কভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়তে থাকায় যারা টিকা নেয়নি, তারা আয়ারল্যান্ডে পুরোপুরি লকডাউনের আওতাভুক্ত থাকবে বলে জানিয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাইকেল মার্টিন।

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে গৃহবন্দিত্ব অনেকেই মেনে নিতে চাইছে না তা ঠিক, কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হলে আবার যে লকডাউনকেই বেছে নেয়া হবে, তেমন ইঙ্গিতই যেন দিচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *