লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে

গত ২৯ মে লিবিয়ায় ২৬ ভাগ্যান্বেষী বাংলাদেশী অভিবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। লিবিয়ায় কোনো কেন্দ্রীয় সরকার না থাকায় এই ধরনের ঘটনার জন্য কাউকে জবাবদিহি করা যায় না। ২০১১ সালে সাবেক স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর থেকে প্রায় এক দশক হতে চললেও কার্যত গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। এক সময়ের আফ্রিকার তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনকারী দেশ লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে আছে? এই প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে আরো কিছু বিষয় জড়িত। 

এক দেশ দুই সরকার
২০১১ সালে ন্যাটো সমর্থিত সামরিক অভিযানে গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হলেও দেশটিতে এখন পর্যন্ত স্থায়ী কোনো ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিবদমান পক্ষগুলোকে সাথে নিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, যা গভর্মেন্ট অব ন্যাশনাল একর্ড (জিএনএ) নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে ফায়েজ আল সারাজের নেতৃত্বাধীন  জিএনএ সাথে বিরোধে লিপ্ত হয় খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি(এলএনএ)। বর্তমানে ত্রিপোলিতে অবস্থিত জিএনএর দখলে আছে সমূদ্রতীরবর্তি ত্রিপোলি, মিসরাতার মতো জনবহুল শহর, অন্যদিকে হাফতারের এলএনএর নিয়ন্ত্রণে আছে পূর্ব ও দক্ষিণের বিস্তীর্ণ জনবিরল অঞ্চল এবং সির্ত, তর্বুক, ডের্না এবং বেনগাজির মতো বড় শহর।  লিবিয়ায় প্রকৃতপক্ষেই দুইটি আলাদা সরকার যাদের অধীনে রয়েছে আলাদা সেনাবাহিনী। এর মধ্যে খলিফা হাফতার গত মার্চে পুরো লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাজধানী ত্রিপোলি দখলের ঘোষণা দিলে নতুন করে অস্থিতিশীলতার সূত্রপাত ঘটে। শক্তিশালী বিমানবাহিনী থাকায় হাফতারবাহিনী শুরুতে বেশ কিছু শহর দখল করে নির্বিঘ্নেই ত্রিপোলির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরপর তুরস্ক জাতিসংঘ সমর্থিত সারাজের নিয়ন্ত্রাধীন জিএনএ-র সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ, অত্যাধুনিক ড্রোন আর সিরিয়া থেকে বিদ্রোহীদের এনে হাফতার বাহিনীর ত্রিপোলি অভিযান রুখে দিতে সক্ষম হয়। ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে আপাতত পিছু হটতে বাধ্য হয় 

প্রক্সি যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র
দুইটি পরস্পর বিরোধী সরকারের নেতৃত্বে দুইজন লিবিয়ান থাকলেও আদতে সিরিয়া, ইয়েমেনের পর বৃহৎ  আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর প্রক্সিযুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে লিবিয়া। আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার এবং লিবিয়ার বিপুল জ্বালানি সম্পদের দখল নেওয়াকেই বিশ্লেষকরা এর কারণ বলে মনে করছেন। বিবাদমান দুই পক্ষের মধ্যে একদিকে রয়েছে জিএনএ যারা তুরষ্কের শক্তিশালী সমর্থন পেয়ে আসছে। যদিও কাগজকলমে জিএনএ জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থনধারী সরকার হলেও শুরু থেকেই ফ্রান্স ও ইতালির মতো শক্তিশালী ইউরোপীয় শক্তি হাফতারের এলএনএর দিকে ঝুঁকে পড়ে। পরবর্তীতে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ইসরায়েলসহ রাশিয়া হাফতারকে পুরো লিবিয়ার শাসক বানাতে সর্বাত্মক সহযোগিতা শুরু করে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত জোট কাতারে অবরোধ দিলে তুরস্ক কাতারের পক্ষে এগিয়ে আসে, তেমনি লিবিয়া গৃহযুদ্ধেও তারা আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে পরস্পরবিরোধী বাহিনীর পক্ষ নিয়েছে। অন্যদিকে সিরিয়াতে রাশিয়া বাশার আল আসাদের পক্ষ নেয় আর তুরস্ক পক্ষ নেয় আসাদবিরোধীদের। লিবিয়াতেও দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে আছে। তুরস্কের সামরিক সহায়তায় জিএনএর প্রতি-আক্রমণের মুখে এই সপ্তাহে হাফতারের বাহিনী ত্রিপোলি থেকে পিছু হটতে শুরু করে।  জিএনএ এর পক্ষে এরদোয়ানের তুরস্কের সামরিক সহায়তার সমালোচনা করে খলিফা হাফতার একে অটোমান ঔপনিবেশের সাথে তুলনা করেন। যদিও এটা সত্য যে, এরদোয়ান গত কয়েক বছর ধরে সাবেক অটোমান দেশগুলোর উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, কিন্তু খালিফা হাফতার নিজেই বিদেশি শক্তিগুলোর কাছ থেকে অবাধ সহযোগিতা পেয়ে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিদ্ধস্ত অন্যান্য দেশসমূহ যেমন সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবাননের মতোই আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের বলি হচ্ছে লিবিয়া। 

প্রয়াত স্বৈরশাসক গাদ্দাফির ছায়া
গত মার্চে প্রভাবশালি সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গে চাঞ্চল্যকর এক রিপোর্ট হয়। সেখানে দাবি করা হয়, হাফতার নয় রাশিয়ার সহায়তায় লিবিয়ার ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে সাবেক স্বৈরশাসক গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলাম গাদ্দাফি। সে লক্ষ্যে কুখ্যাত রাশিয়ান মার্সেনারি বা ভাড়াটে সেনার দল ভাগনার গ্রুপকে নিয়োগ করা হয়। ইয়েভজেনি প্রিগোজিন নামের পুতিনের ঘনিষ্ঠভাজন বলে চিহ্নিত এক ব্যবসায়ী ভাগনার গ্রুপের প্রধান। রাশিয়ান ভাগনার গ্রুপের ইতোপূর্বে পূর্ব ইউক্রেনে গৃহযুদ্ধের জন্য কুখ্যাতি রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এক হাজার মিলিশিয়ার শক্তিশালী একটি দল হাফতারের পক্ষে যুদ্ধের জন্য লিবিয়ায় বর্তমানে অবস্থান করছে। রিপোর্টে দাবি করা হয় রাজধানী ত্রিপোলি দখল করলে হাফতারের পরিবর্তে গাদ্দাফিপুত্র সাইফ ক্ষমতায় বসবে। খালিফা হাফতারের পূর্ব ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এ দাবি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একসময় গাদ্দাফির বিশ্বস্ত সেনাপতি হাফতার ১৯৮৬ তে আফ্রিকার দেশ চাদ দখলে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ধরা পড়ে। পরবর্তীতে মুক্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায় এবং ভার্জিনিয়ায় সিআইএ এর সদর দপ্তরের পাশেই আস্তানা গাড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করা হাফতার গাদ্দাফির পতনের আগ মুহুর্তে লিবিয়া হাজির হয় এবং গাদ্দাফি পতনে ভুমিকা রাখে। ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুযায়ী হাফতারের অনুগত বাহিনীর একটা বড় অংশই গাদ্দাফির ছেলে সাইফের অনুগত। এছাড়া গাদ্দাফির পক্ষে যুদ্ধ করা বিভিন্ন গোত্রের যোদ্ধারা, সুদানের জাঞ্জাবিদ বিদ্রোহীগোষ্ঠিও হাফতারের বাহিনীতে ভিড়েছে। যদিও হাফতারকে মিশরের ফাত্তাহ আল সিসির মতো স্বৈরশাসক হিসেবে বসানোই সৌদি-আরব আমিরাত জোটের মূল লক্ষ্য ছিল। তবুও সাবেক স্বৈরশাসকের পুত্র হিসেবে সাইফ গাদ্দাফির এক ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান উড়িয়ে দেওয়া যায় না। 

আসল পরাজিত লিবিয়ার জনগণ
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমা পরাশক্তিরা গাদ্দাফির পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রায় স্বৈরতন্ত্র পতনের এক দশক হতে চললেও লিবিয়ায় গণতন্ত্র তো দূরে থাক, স্থায়ী কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পশ্চিমা পরাশক্তিরাও যার যার স্বার্থে বিভক্ত। জানুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া তুরস্ক সিরিয়া ইস্যুর মতো করে যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে জার্মানির উদ্যোগে বার্লিন সম্মেলন করলেও কোন আশানরূপ ফল পাওয়া যায় নি। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালেই লিবিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধে দুই লক্ষ লোক গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং প্রাণ হারায় হাজার হাজার লোক। এক সময়ের আফ্রিকার শান্তিপূর্ণ সম্পদশালী দেশ লিবিয়া এবং পরিণত হয়েছে ব্যর্থ রাষ্ট্রে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তার প্রশাসনের বেশিরভাগ উদ্যোগই লিবিয়ান তেল কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার দিকেই নিবদ্ধ ছিল। চলমান গৃহযুদ্ধের কোন রকম রাজনৈতিক সমাধানে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। তাই গৃহযুদ্ধের দশম বছরে এসেও করোনা ভাইরাসের সাথে সাথে লিবিয়ার জনগণ তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইও চালিয়ে যেতে হচ্ছে। 

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *