ভারতের প্রতি শি জিনপিংয়ের কঠোর মনোভাবের নেপথ্যে

হিমালয়ে ভারতীয় সেনাদের ওপর নৃশংস হামলাটি বেইজিংয়ের সাম্প্রতিক আগ্রাসনমূলক পদক্ষেপের একটি। বর্তমানে বিশ্বে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই চালিয়ে যাওয়া চীনের পক্ষে কি ভারতের শত্রুতা হজম করা সম্ভব—এ নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানের এ বিশ্লেষণ।

চীনা সৈন্যরা ভারতীয় একটি টহল দলের ওপর যেভাবে হামলে পড়েছে তা মধ্যযুগীয়। হিমালয়ের ওপরে বিরোধপূর্ণ নো ম্যানস ল্যান্ডে যেকোনো ধরনের সংঘাত এড়িয়ে চলতে উভয় বাহিনীই কোনো অস্ত্র বহন করতে পারেন না। কিন্তু সংঘাতের দিনে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সেনারা কৃত্রিমভাবে পানি আটকে রেখেছিল। ভারতীয় সেনারা অগ্রবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানির প্রবাহ ছেড়ে দেয়া হয়। তারপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে ভারতীয় সেনাদের ওপর চীনা সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে জানায় ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো।

উভয় পক্ষের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী হাতাহাতি লড়াই চলে। অনেক ভারতীয় সেনা পাহাড় থেকে পড়ে মারা যান। লড়াই শেষে দেখা গেছে অন্তত ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছেন। ডজনখানেক আহত হওয়ার পাশাপাশি বেশ কয়েকজনকে বন্দি করে রেখেছে চীনা সেনারা। চীনেরও বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছে কিন্তু এর তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেনি বেইজিং।

সর্বশেষ এ সংঘাতের ঘটনায় প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে স্বাক্ষরিত একটি দুর্বল শান্তি চুক্তি ভেঙে গেল। গত সপ্তাহের সংঘাতের আগে গত ৪৫ বছরে উভয় পক্ষের কোনো সেনা মারা যায়নি। সীমান্ত নিয়ে ১৯৬২ সালে চীন ও ভারত যুদ্ধ করেছিল। ১৯৬৭ সালেও উভয় পক্ষের মধ্যে লড়াই বাধে। তত্পরবর্তী সময়ে উভয়পক্ষই বড় আকারের বিরোধ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু গত সোমবারের সংঘাতের ফলে দুটি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্র তিক্ত পরিস্থিতির সামনে এসে দাঁড়াল। গত কয়েক বছরে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজ নিজ দেশের হতাহত সেনাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় উভয় নেতাই দুর্বলতা প্রদর্শনের সামর্থ্য রাখেন না।

বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ করে ভারত ‘ইচ্ছাকৃতভাবে এ উসকানিমূলক আচরণ করেছে’ বলে শনিবার অভিযোগ এনেছে চীন। তবে ভারতের দাবি তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতেই ওই অবকাঠামোগুলো নির্মাণ করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসির কাছাকাছি অবকাঠামো নির্মাণসহ টহল বাড়িয়েছে চীন। বিভিন্ন অবস্থানে চীনা সেনারা তাদের উপস্থিতি শক্তিশালী করেছে। যে পাহাড়ি অঞ্চলে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধেছে, সেখানে এক মাস আগেও সংঘর্ষ বেধেছিল। গত সোমবারের প্রাণঘাতী লড়াইয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সর্বোচ্চ মহল থেকেই এ নির্দেশনা এসেছে।

প্রায় সম-জনসংখ্যাবিশিষ্ট বিশাল প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে চীনের বিরোধ কী যুক্তিযুক্ত—এমন প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। নভেল করোনাভাইরাস মহামারীসহ বেশকিছু সংকটে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে চীন। ১৯৭০-এর দশকে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালুর পর ওয়াশিংটনের সঙ্গে সবচেয়ে কঠিন সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বেইজিং। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে হংকংয়ে বেইজিংবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। হংকংয়ের ওপর বিতর্কিত একটি নিরাপত্তা আইন চাপিয়ে দেয়ায় আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে চীন। কভিড-১৯-এর উৎস সম্পর্কে অস্ট্রেলিয়ার তদন্তের দাবিতে ক্যানবেরার সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছে বেইজিং। এছাড়া হুয়াওয়ের এক শীর্ষ নির্বাহীকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রত্যর্পণ নিয়ে কানাডার সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছে চীনের।

কিছু বিশ্লেষক মনে করেন যে ভারত সীমান্তে আগ্রাসন হলো এই দেশীয় চাপের প্রতিক্রিয়া। শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে বিরোধ এবং আর্থিক বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সার্বভৌমত্ব ইস্যুতে তিনি যেন দুর্বল প্রতীয়মান না হন সেজন্য এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সিকিউরিটি স্টাডিজ প্রোগ্রামের পরিচালক টেলর ফ্রেভেল বলেন, আমি মনে করি শি জিনপিং যে চাপের মধ্যে রয়েছেন, তার একটি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এটি।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *