যেভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতি চিরতরে বদলে দিয়েছে মহামারী

২০২০ সালে নভেল করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত যে অর্থনৈতিক ধাক্কা দেখা গেছে, তা কয়েক প্রজন্ম পর একবারের জন্য হয়তো আসে। তবে সেই ধাক্কা স্থায়ী বিস্তৃত ছাপ রেখে যায়। ভ্যাকসিনের আগমন অবশ্য ২০২১ সালে পুনরুদ্ধারের গতিকে দ্রুততর করার সম্ভাবনা জাগিয়েছে, কিন্তু কভিড-১৯-এর অন্য যেসব প্রভাব, তা সামনের বছরগুলোয় বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে নতুন আকার দেবে।

এ প্রভাবগুলোর কিছু এরই মধ্যে বোঝা যাচ্ছে। সামনের দিনে হয়তো কারখানা ও সেবামূলক কাজের দখল নেবে রোবট এবং হোয়াইট কলার কর্মীরা হয়তো বাসায় বসে কাজ করবেন। পাশাপাশি দেশগুলোর বৈষম্য হয়তো আরো বেড়ে যাবে। সরকারগুলো জনগণের জীবনের ওপর আরো বেশি প্রভাব রাখবে। তেমন কিছু পরিবর্তনের ওপর নজর দেয়া যাক এবার—

দৈত্যাকার রাষ্ট্র

সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সামাজিক চুক্তি পুনর্লিখিত হওয়ার সঙ্গে বৃহৎ সরকারের ধারণা আবারো মঞ্চস্থ হওয়ার একটা পথ খুঁজে পেল। কর্তৃপক্ষের জন্য এটা খুবই নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠল যে মানুষ কোথায় যাচ্ছে এবং কাদের সঙ্গে দেখা করছে তা অনুসরণ করা। পাশাপাশি মালিকপক্ষ বেতন দিতে ব্যর্থ হলে সেটাও দিয়ে দিচ্ছে তারা।

ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানির মতে, এ ধরনের হস্তক্ষেপমূলক খরচের জন্য বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো ঘাটতি বাজেট পরিচালনা করে, যা কিনা এ বছর যোগ করেছে ১১ ট্রিলিয়ন ডলার। এরই মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে যে কতদিন পর্যন্ত এই ব্যয় চালিয়ে নেয়া হবে এবং কখন থেকে করদাতারা বিল দিতে শুরু করবেন। দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে সরকারি ঋণের ব্যাপারে মানসিকতা পরিবর্তন করছে।

ঋণ ও জম্বি কোম্পানি

সরকার এই মহামারীকালীন লাইফলাইন হিসেবে অর্থ ধার দিয়েছে এবং ব্যবসাগুলো তা লুফে নিয়েছে, যার একটি ফল হচ্ছে উন্নত বিশ্বজুড়ে করপোরেট ঋণের স্তর বৃদ্ধি পাওয়া। ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টের হিসাবে, ২০২০ সালের প্রথমার্ধে অ-আর্থিক কোম্পানিগুলো ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ধার নিয়েছে। এদিকে লকডাউন ও ভোক্তা সতর্কতার কারণে অনেক শিল্পের রাজস্ব ডুবে গেছে। পাশাপাশি ব্যবসার ব্যালান্স শিটকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

এদিকে ঋণ পরিশোধ করতে না পারা জম্বি কোম্পানিগুলো অবিশ্বাস্যভাবে ব্যাপক ঋণ নিয়েছে। যাতে বিপদ দেখছেন অনেকেই। কেউ কেউ এটাকে আবার জম্বি কোম্পানি তৈরির প্রক্রিয়া হিসেবেও দেখেন। যারা কিনা মুক্ত বাজারে টিকে থাকতে পারে না এবং রাষ্ট্রের সহায়তায় কেবল টিকে থাকতে পারে। এতে গোটা অর্থনীতি কম উৎপাদনশীলতার দিকে চালিত হয়।

ব্যাপক বৈষম্য

এ বিতর্কগুলো উন্নত বিশ্বের বিলাসিতা বলেও মনে হতে পারে। দরিদ্র দেশগুলোর চাকরি ও ব্যবসাকে রক্ষার সুযোগ কম রয়েছে এবং তাদের ভ্যাকসিনে বিনিয়োগ করার সুযোগও নেই।

বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, মহামারী নতুন প্রজন্মের দারিদ্র্য ও ঋণ জটিলতার সূচনা করেছে। আইএমএফ বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো এক দশক পর্যন্ত পিছিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

কে-আকারের পুনরুদ্ধার

কে-আকারের পুনরুদ্ধারের অর্থ হচ্ছে একেকটি খাত একেক সময়ে ও ভিন্ন হারে ঘুরে দাঁড়ানো। কম পারিশ্রমিক দেয়া সেবাগুলোয় অধিক সরাসরি সংস্পর্শে আসার প্রয়োজন হয়, যা অর্থনৈতিক লকডাউনের সঙ্গে প্রথমেই হারিয়ে যেতে শুরু করে। তাছাড়া আর্থিক বাজার, যেখানে সম্পদের মালিক মূলত ধনীরা, সেগুলো চাকরির বাজারের চেয়ে অনেক দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ফলে ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন শ্রেণী, বর্ণ ও লিঙ্গের মানুষের আয় ও সম্পদের পার্থক্যও আরো বেড়েছে।

রোবটের উত্থান

কভিড-১৯ এখন শিল্প-কারখানাগুলোয় শারীরিকভাবে সংস্পর্শে যে অভ্যাস, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এসব স্থানে সামাজিক দূরত্ব বেশ কঠিন ব্যাপার। যেমন রিটেইল, আতিথেয়তা কিংবা গুদামগুলোর কথা বলা যেতে পারে। ফলে মানুষের জায়গায় এখন এসব ক্ষেত্রে রোবট চলে আসতে পারে। গবেষণাগুলো বলছে, অটোমেশন মন্দার সময় প্রায়ই নিজেদের অবস্থান খুঁজে পায়। এই মহামারীকালীনও তার ব্যতিক্রম নয়।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *