মজুতদারের কারসাজিতে পাটের দামে রেকর্ড: সব পাট কিনে নিয়েছেন মজুতদাররা, কমেছে উৎপাদনও

গত বছর পাটের মৌসুমে প্রতি মণ ভালো মানের পাট বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। সেই একই পাট বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার টাকার ওপরে। গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আরো বেশি দামে পাট বিক্রি হয়েছে, যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য! পাটের দামের ক্ষেত্রে এটা রেকর্ডও।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মৌসুমের শুরুতেই মজুতদারেরা কৃষকের কাছ থেকে সব পাট কিনে নিয়েছেন। ফলে পাটের এই বাড়তি দরের মুনাফা যাচ্ছে মজুতদার আর ফড়িয়াদের পকেটে। তারা জানান, এমনিতেই সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হওয়ার পর এই খাত যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া পাট পচানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাব, পাটবীজের আমদানিনির্ভরতাসহ বিভিন্ন কারণে গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিককভাবে কমছে পাটের উৎপাদন। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্ রপ্তানি আয়ের এই খাত এখন নিজেই ধুঁকছে। ইতিমধ্যে কাঁচা পাটের অভাবে অনেক পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পাটের বাজার ধরে রাখা মুশকিল হবে।

কেন বাড়ছে পাটের দাম :বিশ্বে পাটপণ্যের চাহিদা বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারেও। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী পাটের উৎপাদন না বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে দামের ওপর। মাটি ও আবহাওয়ার কারণে দেশে সবচেয়ে ভালো মানের পাট উৎপাদন হয় ফরিদপুর অঞ্চলে। ফরিদপুরের সব থেকে বড় পাটের বাজার কানাইপুর, সাতৈর, কৃষ্ণপুর, সালথা, ময়েনদিয়া, নগরকান্দায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সপ্তাহ থেকে পাটের দাম প্রতি মণে ৫০০ থেকে হাজার টাকা বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, পাটের জোগান কম, কিন্তু চাহিদা বেশি থাকায় দাম বেড়েছে। অন্যদিকে মিলমালিকদের দাবি, মজুতদারদের সিন্ডিকেটই পাটের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
[১] টানা ৪ দনি পর আখাউড়া স্থলবন্দর সচল ≣ [১] জলবায়ু যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য আমার দর্শন, নিজেকে সাহায্য করো, কারও অপেক্ষা করো না: প্রধানমন্ত্রী ≣ কলাপাড়ায় লকডাউনের প্রথম দিনে তিন ব্যবসায়িকে অর্থদন্ড।

কানাইপুর বাজারের পাট ব্যবসায়ী কুমারেশ সাহা জানান, হাটে-বাজারে পাটের জোগান নেই, মিলগুলো বন্ধ থাকায় বেচাকেনাও নেই। ঈদের আগে মিল খোলা থাকা পর্যন্ত কিছু বেচাকেনা হয়েছে। তিনি বলেন, তাদের বাজারে এখন পাটের দাম যাচ্ছে ৪ হাজার ৮০০ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে, যা ঈদের আগে ছিল ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৪০০ টাকার মধ্যে। তিনি বলেন, আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন পাট উঠলে অবস্থা স্বাভাবিক হবে।

সালথা এলাকার পাটচাষি নাহিদ শেখ জানান, পাট তো এখন কৃষকের কাছে নেই। পাট যা আছে তা ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে মজুত করা। তারাই দাম বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘পাটের এই বাড়তি দরে আমাদের কোনো লাভ নেই। আমরা যখন বাজারে পাট বিক্রি করেছি, তখন প্রতি মণ পাটের দাম ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জুট মিলে পাট সরবরাহ করেন এমন এক এজেন্ট জানান, তারা নগদ টাকা দিয়ে পাট কিনে মিলগুলোতে দেন। মিলগুলো সেই পাট দিয়ে পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করে। অথচ তাদের পাটের পাওনা টাকা পাওয়ার জন্য মাসের পর মাস কখনো বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। আর এ কারণেই মিলে একটু বেশি দামেই পাট দেন ব্যবসায়ীরা।

এমএইচ গ্লোন্ডেন জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসিন হোসাইন ইত্তেফাককে বলেন, বর্তমানে যে দরে পাট বিক্রি হচ্ছে, তাতে পণ্য তৈরি করে লাভ করা দূরে থাক, লোকসান গুনতে হবে মিলগুলোকে। তিনি বলেন, তার মিলসহ জেলার যেসব মিল চালু আছে, সবার উৎপাদন অর্ধেক বা তারও কম হচ্ছে এখন। কয়েকটি মিল তো বন্ধই হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। এই মিলমালিক আরো জানান, কৃষকদের কাছ থেকে পাট তাদের কমই কেনা হয়, মিলগুলো পাট কিনে থাকে ছোট-বড় পাট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। আর এদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। সুযোগ বুঝে পাটের দাম বাড়ানো-কমানোসহ পুরো নিয়ন্ত্রণই এই সিন্ডিকেটের হাতে। এখন যা পাট আছে, তার পুরোটাই ব্যবসায়ীদের হাতে। তাই দামও তারা ইচ্ছেমতো নিচ্ছে। আর মিল চালাতে গেলে পাট তো কিনতে হবেই, না হলে মিল বন্ধ করে রাখতে হবে।

এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের একটি বড় শিল্প গ্রুপ চলতি মৌসুমে পাটের ব্যাপক মজুত করেছে। বর্তমানে তারা পাটের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে।

কমছে পাটের উৎপাদন

দেশে-বিদেশে পাটের চাহিদা বাড়লেও এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পাটের উৎপাদন কমছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ৭ লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়। উৎপাদন হয় ৮৫ লাখ ৭৬ হাজার বেল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ লাখ ৯৯ হাজার হেক্টর জমিতে পাট উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয় ৬ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে। এ বছর পাট উৎপাদন হয় ৮০ লাখ বেল। ২০২০-২১ অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম জমিতে পাট উৎপাদন হয়। এ বছর ৭ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। শেষ পর্যন্ত আাাবাদ হয় মাত্র ৬ লাখ ৮২ হাজার হেক্টর জমিতে। আর পাট উত্পাদন হয় ৭৭ লাখ বেল। এ হিসাবে ধারাবাহিকভাবে পাট উৎপাদন কমছে।

পাটচাষিরা বলেছেন, প্রতি বছরই পাটের দামে ব্যাপক ওঠানামা হয়। সে কারণে বেশির ভাগ সময় লোকসানের মুখ দেখতে হয়। এছাড়া পাট পচানোর জন্য পানির অভাব রয়েছে। রয়েছে পাটবীজের অভাব। প্রতি বছর দেশে ৫ হাজার ২০০ টন পাটবীজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৭০০ থেকে ৮০০ টন বীজ দেশে উৎপাদন হয়। বাকি বীজ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু এই বীজের দামও প্রতি বছর ওঠানামা করে। চাষিরা বলেন, পাট চাষে যে সময় ব্যয় করা হয়, সেই একই সময়ে দুটি ফসল ফলানো যায়। তাই পাট ছেড়ে অন্য ফসল চাষে মনোযোগী হচ্ছেন তারা। –

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *