বেড়েছে পণ্যবাহী জাহাজের সংখ্যা উন্নত হয়নি অবকাঠামোগত সুবিধা

যশোরের নওয়াপাড়া নদীবন্দর। ২০০৪ সালের এপ্রিলে অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় এটি স্থাপনের ঘোষণা দেয়া হয়। নির্মাণ শেষে ২০০৭ সালের মে মাসে শুরু হয় এর কার্যক্রম। ভৈরব নদের চেঙ্গুটিয়া থেকে ভাটপাড়া ফেরিঘাট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা নির্ধারণ করা হয় নদীবন্দরটির। শুরু হয় রাজস্ব আয়। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে নদীবন্দরটির কর্মব্যস্ততা। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বন্দরটি দিয়ে পণ্য খালাসের পরিমাণ বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে রাজস্ব আয়ের পরিমাণও। তবে এ দুটোর সঙ্গে সমন্বয় করে নদীবন্দরের অবকাঠামোগত সুবিধার কোনো উন্নতি হয়নি।

নওয়াপাড়া নদীবন্দর দিয়ে মূলত সার, সিমেন্ট, কয়লা, গমসহ বিভিন্ন পণ্য আসে। নদীবন্দটির সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৬৮টি জাহাজে আমদানি পণ্য এসেছে ৭ লাখ ৮৪ হাজার টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ হাজার ৫টি জাহাজে পণ্য এসেছে ১০ লাখ ৩৩ হাজার ৭০০ টন এবং সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৩০০ জাহাজে ১১ লাখ ৫০ হাজার ৩০০ টন পণ্য এসেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওয়াপাড়া নৌবন্দরে বর্তমানে আটটি জেটি ও একটি পন্টুন রয়েছে। পণ্য আমদানির পর খালাস করার জন্য এগুলো নির্মাণ করেছিল কর্তৃপক্ষ। তবে আমদানি পণ্যের পরিমাণ বাড়লেও বিদ্যমান এসব অবকাঠামো আদৌ কাজে আসছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব জেটি ব্যবহার করছেন না তারা। কারণ নদীর তীর থেকে জেটি ও পন্টুন অনেক দূরে হওয়ায় লেবার খরচ ও সময় বেশি লাগে। এজন্য তারা গাইডল নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া বর্তমান বন্দরের সক্ষমতা অনুযায়ী ৪০-৫০টি জেটির প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সড়ক, রেল ও নদীপথে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নওয়াপাড়ায় ব্যাপক প্রসার ঘটে সার, খাদ্যশস্য ও সিমেন্ট ব্যবসার। নওয়াপাড়া পরিণত হয় দেশের অন্যতম বড় বিপণন কেন্দ্রে। আমদানি করা সার ও খাদ্যশস্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে বড় জাহাজ থেকে খালাসের পর তা ছোট বার্জ ও কার্গোতে করে নদীপথে নওয়াপাড়া বন্দরে আনা হয়। আর এ কারণে সে সময় ভৈরব নদে প্রতিদিন অর্ধশতাধিক বার্জ ও কার্গো থেকে পণ্য ওঠানো-নামানো হতো।

এছাড়া ভারত থেকে স্থলপথে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার বেশির ভাগ রেলের ওয়াগনে করে দর্শনা স্থলবন্দর হয়ে নওয়াপাড়ায় আনা হয়। এসব পণ্য সড়ক ও নদীপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ, ওয়্যারহাউজের সুবিধাদি বৃদ্ধি, নদী ভাঙনরোধে কি-ওয়াল নির্মাণ, মালামাল ওঠানো-নামানোর জন্য আরসিসি সিঁড়ি নির্মাণ এবং মালবাহী ট্রাকের জন্য পার্কিং ইয়ার্ড নির্মাণ করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরটি আধুনিকায়নের ক্ষেত্রেও নেয়া হচ্ছে না কোনো প্রকল্প। সরকার এ বন্দর থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করলেও তারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

সার ও খাদ্যশস্য আমদানিকারক আদিত্য মজুমদার বলেন, নদের ভাঙন রোধে কি-ওয়াল এবং বার্জ ও কার্গো থেকে মালামাল ওঠানো-নামানোর জন্য প্রয়োজনীয় সিঁড়ি, সড়ক ও মালবাহী ট্রাকের জন্য পার্কিং ইয়ার্ড না থাকায় প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। আমরা নিজেদের ঘাটও নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছি। নওয়াপাড়া নদীবন্দরে পণ্য আমদানি বোঝাই জাহাজের হার বাড়লেও কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। শুধু ট্যাক্স দিয়েই যাচ্ছি। কোনো সুবিধা পাচ্ছি না।

নওয়াপাড়া সার ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ জালাল হোসেন বলেন, ভৈরব নদ ঘিরে নওয়াপাড়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। আমরা ঠিকমতো ট্যাক্স দিচ্ছি। কিন্তু নদীবন্দরের কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। এখানে ছোট জাহাজ এলেও ঘাটে ভিড়তে পারে না। এজন্য আমরা গাইডল নির্মাণের দাবি করেছিলাম। কিন্তু তা করা হয়নি।

বন্দর সূত্র অনুযায়ী, নদের দুই তীরভূমির পরিমাণ ৫১ দশমিক ৫৫ একর। তবে এর বেশির ভাগ জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে পাট, সার, সিমেন্ট, চাল ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘাট-গুদাম।

যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও আমদানিকারক মিজানুর রহমান খান বলেন, প্রতি বছর বন্দরটিতে পণ্য আমদানি বাড়ছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। নদী খনন করে এর পরিধি ও সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। তাহলে যশোরাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বন্দরটি ব্যবহারে আগ্রহ বেশি দেখাবেন।

এ ব্যাপারে নওয়াপাড়া নৌবন্দরের সহকারী পরিচালক মাসুদ পারভেজ বলেন, বর্তমানে ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্দরের ৩৭ কিলোমিটারে ৩০ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের কাজ চলছে। কাজটি প্রায় শেষের দিকে। এটি সম্পন্ন হলে জাহাজ আরো বেশি যাতায়াত করতে পারবে।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, নদীবন্দরটির অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এটি পাস হলেই অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা আরো বাড়ানো হবে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *