২৭ নভেম্বর, ২০২০। দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঝরে পড়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আরেক নক্ষত্র। জীবনমঞ্চ ছেড়ে চলে যান একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব আলী যাকের। গতকাল ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। বার্ধক্য ও হূদরোগের সমস্যাসহ কিছু শারীরিক জটিলতা নিয়ে কয়েকদিন আগে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আলী যাকেরকে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় সেখানে তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। অবশেষে করোনার কাছে হেরে যান নূরলদীন খ্যাত নন্দিত অভিনেতা। গতকাল তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে তার মরদেহ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নেয়া হয়। গার্ড অব অনার প্রদান করা হয় সেখানে। এরপর বিকালে বনানী কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয় তার। কয়েক বছর আলী যাকের ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। তাই সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে নিজেকে কিছুটা সরিয়ে নিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের মুনীর চৌধুরীর নির্দেশনায় আরণ্যক নাট্যদলের প্রথম ‘কবর’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে পথচলা শুরু করেন এ নাট্যব্যক্তিত্ব। একই বছর তিনি যোগ দেন নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে। তারপর থেকে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় হয়ে ওঠে তার ঠিকানা। অভিনয় জগতে কখনো নূরলদীন, কখনো গ্যালিলিও, কখনো দেওয়ান গাজী হয়ে মঞ্চে দেখা দিয়েছেন দর্শকদের। এ তিন চরিত্রের জন্য মঞ্চপ্রেমীদের কাছে আজো স্মরণীয় আলী যাকের। এছাড়া ‘বাকি ইতিহাস’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘কোপেনিকের ক্যাপটেন’, ‘ম্যাকবেথ’সহ অনেক আলোচিত মঞ্চনাটকের অভিনেতা ও নির্দেশক তিনি। মঞ্চের পাশাপাশি টিভি নাটকেও সমাদৃত হন আলী যাকের। ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি’, ‘পাথর’, ‘দেয়াল’সহ বহু কালজয়ী নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। বেতারে ৫০টিরও বেশি নাটকে অভিনয় করেন। অভিনয় করেন বেশকিছু চলচ্চিত্রেও।
অভিনয়ের পাশাপাশি লেখালেখিও করতেন আলী যাকের। টেলিভিশনের জন্য মৌলিক নাটক লিখেছেন। দৈনিক পত্রিকাতেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাকে লিখতে দেখা গেছে। তার প্রকাশিত বই ‘সেই অরুণোদয় থেকে’, ‘নির্মল জ্যোতির জয়’। আলোকচিত্রের প্রতিও ছিল তার আগ্রহ।
আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির পূর্ণ সদস্য। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ অনেক পুরস্কার, সম্মাননা। আলী যাকের এক সময় গড়ে তোলেন দেশের বৃহৎ বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি।
১৯৪৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার রতনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আলী যাকের। তিনি ছিলেন চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। তার বাবা মোহাম্মদ তাহের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় বাবার চাকরির বদলির সুবাদে অল্প বয়সে কুষ্টিয়া ও মাদারীপুরে কাটান।
কিংবদন্তি এ অভিনেতার প্রয়াণে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমেছে শোকের ছায়া। আলী যাকের তার জীবদ্দশায় অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আলী যাকেরের প্রয়াণে তাকে নিয়ে টকিজের সঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লুবনা মারিয়াম ও মঞ্চসারথী আতাউর রহমান খান। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো—
তরুণ প্রজন্মকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে শেষাবধি কাজ করেছেন —লুবনা মারিয়াম
সাংস্কৃতিক জগতে ছোটলু (আলী যাকের) ভাইয়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। তার অনেক পরিচয়। তিনি অভিনেতা, নির্দেশক, শব্দসৈনিক। তিনি একজন কিংবদন্তি ছিলেন। নিজের কাজের মধ্য দিয়ে অনেক পথ দেখিয়ে গেছেন সবাইকে। বিজ্ঞাপন ও নাট্যাঙ্গন—দুই জগতের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যেতে নতুন প্রজন্মকে তৈরি করেছেন। তরুণ প্রজন্মকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে শেষাবধি কাজ করেছেন। এজন্য তার কাছে আমাদের সবার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আরেকটি বিষয় হলো তিনি তার কাজে সবসময় স্ত্রী সারা যাকেরকে পাশে রেখেছেন। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে কাজ করেছেন। সচরাচর এমনটা দেখা যায় না।
বাংলা নাট্যচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ আলী যাকের —আতাউর রহমান
১৯৭২ সাল থেকে আমরা একটা পরিবারের মতো ছিলাম। সুখে, দুঃখে, গল্পে, আড্ডা, পড়াশোনা, নাট্যনির্দেশনা, অভিনয়—সবকিছুতে। সবসময় হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে কাটাতাম। আমি তার সহকর্মী ছিলাম। প্রথমদিকে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি। পরে আলী যাকের সভাপতি হন। আমি সাধারণ সম্পাদকই থেকে যাই। আমরা দুজনে একসঙ্গে নাটক করেছি, নির্দেশনা দিয়েছি। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে বাংলা নাট্যচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন আলী যাকের। তিনি অভিনয় জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। দর্শনের বিনিময়ে নাটকের টিকিট বিক্রির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে কাজটি শুরু করেছিলেন। খুব বড় অভিনেতা ছিলেন। ম্যাকবেথ, গ্যালিলিও, নূরলদীনের চরিত্রে তার অভিনয় অসাধারণ। কলকাতায়ও তার নাম হয়েছিল খুব। নির্দেশক হিসেবেও খুব ভালো ছিলেন। তার ‘সৎ মানুষের খোঁজে’ নাটকটির কথা বলা যায়। টিভি নাটকেও ভালো করেছিলেন।
১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীনের পর পর নাট্যদল আরণ্যকের প্রথম ‘কবর’ নাটকে অভিনয় করেন আলী যাকের। এটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন মুনীর চৌধুরী। সুভাষ দত্তও অভিনয় করেছিলেন এতে। ওই বছরই তিনি নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যুক্ত হন। তারপর আমার নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। এরপর তার নির্দেশনায় ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকে আমি, আবুল হায়াত, সারা আমীন অভিনয় করি। সারা যাকেরের তখন জন্ম হয়নি।
আলী যাকের ছিলেন সর্বাঙ্গীণভাবে বাঙালি। তিনি ইংরেজিও চমত্কার জানতেন। বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু তার হূদয় বাংলাদেশের মাটিতে প্রোথিত ছিল। তিনি ছিলেন শব্দসৈনিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী একজন মানুষ। সারা পৃথিবী ঘোরা মানুষটি বাংলাদেশের নিসর্গ পছন্দ করতেন অনেক। মাঝেমধ্যেই তার গ্রাম রতনপুর চলে যেতেন। সাহেবীপনা ছিল খুব কম। আলী যাকের সম্পর্কে এক কথায় বলতে গেলে তিনি ছিলেন রেনেসাঁস বা নবজাগরণী পুরুষ পুনর্জাগরণী ব্যক্তিত্ব। নাট্যজগতে তার নির্দেশনা ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের মধ্যে চিরদিন জেগে থাকবেন।
এদিকে আলী যাকেরের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে শোকের মাতম। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের শোক বার্তায় ছেয়ে গেছে অন্তর্জাল। সংগীতশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ লিখেছেন, ‘আলী যাকের। একজন শক্তিশালী অভিনেতা। চলে গেলেন। ওপারে ভালো থাকবেন। আমার পরিবার ও আমি কোনোদিন আপনাকে ভুলব না।’ ‘আবার জানলাম, মৃত্যু এক অনিবার্য পরিণতি। বিদায় প্রিয় মানুষ আলী যাকের। ভালোবাসা’—কথাগুলো লিখেছেন নির্মাতা অনিমেষ আইচ।
নাট্যব্যক্তিত্ব মাসুম রেজার নির্দেশিত প্রথম ও দ্বিতীয় প্যাকেজ নাটকের প্রধান চরিত্রের অভিনেতা ছিলেন আলী যাকের। সেই পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি লেখেন, ‘‘আলী যাকের.. একজন শুদ্ধ শিল্পী.. শিল্পে ব্রত একজন মানুষ.. বিটিভিতে প্যাকেজের আওতায় আমার প্রথম ও দ্বিতীয় নাটক ‘কৈতব’ ও ‘সেকু সেকান্দার’-এর প্রধান চরিত্রের অভিনেতা। টেরিস্ট্রিরিয়াল ইটিভিতে আমার প্রথম সাপ্তাহিক নাটক ‘কূপ’ নাটকেও তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার। একটি নাটক পাঠের নিমিত্তে তিনি আমার বাড়িতেও এসেছিলেন। অসামান্য এ শিল্পীর সঙ্গে আমার হূদ্যতা ছিল। আমার এই গৌরব কোনোদিন ক্ষুণ্ন হবে না। তিনি মৃত্যুকে জয় করা একজন মানুষ। মৃত্যু তাকে মারতে পারবে না কোনোদিন…’’
আলী যাকেরের প্রয়াণে স্তব্ধ হয়ে পড়েছেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। স্বনামধন্য অভিনেতাকে নিয়ে অন্তর্জালে লিখেছেন, ‘জানি যাকের ভাইয়ের শরীরটা অনেক দিন ধরেই খারাপ! কিন্তু কিংবদন্তিদের বিদায়ের জন্য আমরা কখনই প্রস্তুত থাকি না! তিনি যাপন করে গেছেন অর্থবহ একটা জীবন! বহু মানুষের জীবনকেও করে তুলেছেন অর্থবহ! তার অভিনয়, লেখালেখি, ছবি তোলা—সবকিছু নিয়েই তিনি আমাদের সংস্কৃতি জগতের মহীরুহ!’
শিশুতোষ জনপ্রিয় কার্টুন সিসিমপুর। এতে চিকিৎসক কদম আলীর চরিত্র করেছিলেন আলী যাকের। তার প্রয়াণে শোকস্তব্ধ সিসিমপুর পরিবার। তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে সিসিমপুর পরিবার। বিভিন্ন থিয়েটার সংগঠনের পক্ষ থেকে আলী যাকেরকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হচ্ছে।