এবারের দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে চরাঞ্চলের শিশু ও প্রসূতিরা। বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের খাবারই ঠিকমতো জোটাতে পারছেন না, সেখানে শিশুসন্তানদের প্রয়োজনীয় খাবার জোটানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় শিশুদের সুস্থ রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মা-বাবারা। একই অবস্থা প্রসূতি মায়েদেরও। চরাঞ্চলের অধিকাংশ গর্ভবতী নারী বন্যার কারণে সুষম খাদ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যার প্রভাব পড়ছে তার অনাগত সন্তানের ওপরও।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মশালের চরের সাড়ে তিনশ পরিবারের রয়েছে পাঁচ শতাধিক শিশু। চলমান বন্যার পানি ঘর-বাড়িতে ঢুকে পড়ায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে শিশুদের নিয়ে নৌকায় ও ঘরের ভেতর উঁচু মাচানে বসবাস করছেন ওই চরের বাসিন্দারা। একদিকে করোনা ও বন্যায় হাতে কাজ নেই, অন্যদিকে ঘরে খাবারও নেই। এ পরিস্থিতিতে নিজেরা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করলেও শিশুসন্তানদের খাবার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়েছেন মহাবিপাকে।
মশালের চরের সাজেদা বেগম জানান, তার তিনটি সন্তান। একটির বয়স তিন মাস, একটির চার বছর আর একটির সাত বছর। বন্যা শুরুর পর থেকে তারা তিনবেলার মধ্যে একবেলা খাবার খাচ্ছেন। এই একবেলা তারা যা খাচ্ছেন, চার বছর আর সাত বছরের সন্তানও তা-ই খাচ্ছে। কিন্তু কোলের শিশুটিকে নিয়ে বিপদ বেড়েছে। তিনি বলেন, নিজেই ঠিকমতো খেতে পারি না। এজন্য বুকে দুধ আসে না। যা আসে তা দিয়ে কোলের শিশুটার চাহিদা পূরণ হয় না। সব সময় কান্নাকাটি করে।
একই চরের মো. মুছা মিয়া জানান, ঘরে সামান্য চাল ছিল কিন্তু হাতে কোনো টাকা নেই। কাজ বন্ধ এজন্য হাটবাজারেও যেতে পারি না। ভালো-মন্দ কিছু কিনে খাওয়ারও উপায় নেই। আমরা বড়রা তো কোনো রকমে একবেলা খেয়ে বসে বেঁচে আছি কিন্তু ছোট শিশুদের নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছি। তাদের ভালো-মন্দ কিছু খাওয়াতে পারছি না। তারা তাদের চাহিদামতো খেতে না পারায় স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে।
শিশুদের এ দুর্ভোগের চিত্র শুধু মশালের চরের নয়, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা অববাহিকার চার শতাধিক চরাঞ্চলের। প্রয়োজনীয় খাবার না পেয়ে মায়ের কোলেও কান্না থামছে না দুধের শিশুদের।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. বেলাল হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নে ৪ হাজার ২০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে। প্রত্যেক পরিবারেই একজন, দুজন বা তিনজন করে শিশু রয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও প্রসূতি মায়েদের খাবারের কষ্ট বেড়েছে। গত সোমবার উপজেলা প্রশাসন থেকে ৫২টি শিশুখাদ্যের প্যাকেট বরাদ্দ পেয়েছি।
বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোয় শিশু ও প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি জানতে চাইলে কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ড. মো. হাবিবুর রহমান জানান, বন্যার্ত মানুষের সেবা দেয়ার পাশাপাশি আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়েও কাজ করছেন। শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ে যে সাব-সেন্টার রয়েছে, সেখানে শিশু স্বাস্থ্যসেবা যেন পায় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, আমি নিজেও দেখেছি বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় শিশু ও মায়েরা খুবই খারাপ দিন পার করছে। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল থেকে এবং সরকারিভাবে যে সহযোগিতা পেয়েছি, সেখানেও কিন্তু শিশুখাদ্যের বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়ায় কথা বলেছি এবং শিশুদের জন্য সরকারিভাবে আলাদা সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে মায়েদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। এছাড়া যেসব এলাকায় শিশুখাদ্য সংকটের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে, সেসব এলাকার জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তালিকা তৈরি করে আমরা প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করব।