পুনরুদ্ধার কৌশল নিয়ে উভয় সংকটে ইউরোপের ভোক্তানির্ভর খাত

শিগগিরই লকডাউন প্রত্যাহারের রূপরেখা প্রকাশ করবে ব্রিটিশ সরকার। একই পরিকল্পনার কথা ভাবছে ইউরোপের অন্যান্য দেশও। তবে এ পরিস্থিতিতে দীর্ঘস্থায়ী মহামারীতে বিপর্যন্ত ইউরোপের ভোক্তানির্ভর কোম্পানিগুলো এখন এক উভয় সংকটে পড়েছে। ক্ষতি পোষাতে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেবে কিনা এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে তারা।

একটা বিষয় পরিষ্কার যে লকডাউন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে হেয়ারড্রেসার, রেস্টুরেন্ট ও ট্যুরিজম এজেন্সিগুলোতে মানুষের ঢল নামবে। হঠাৎ করে ভোক্তাদের এ ভিড়ের পেছনে একটি প্রধান কারণ হলো, বহু মানুষ তাদের বাধ্যতামূলক অপূর্ণ চাহিদা মেটাবে এবং মহামারীর মধ্যে জমে যাওয়া অর্থ খরচ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে।

কিছু অর্থনীতিবিদ অনুমান করছেন, ভোক্তাবাজারে ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। যেখানে এরই মধ্যে পরিবহন থেকে অবকাশযাপনসহ বিভিন্ন ভোক্তানির্ভর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়িতে দিতে শুরু করেছে। মূল্যস্ফীতি ঝুঁকির প্রধান নিয়ামক বলা হয় বন্ডের সুদ, সেটিও বিশ্বব্যাপী ঊর্ধ্বমুখী। গত সপ্তাহের তথ্য-উপাত্ত বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে খুচরা বিক্রি বাড়ছে এবং যুক্তরাজ্যে বাড়ছে পণ্য ও সেবার মূল্য। কাকতালীয়ভাবে এই দুই দেশই বেশ দ্রুততার সঙ্গে গণটিকাদান কর্মসূচির সফলতা দেখিয়েছে।

অন্যদিকে ইউরোজোনের মঙ্গলবারের উপাত্ত অনুযায়ী, প্রায় এক বছরের মধ্যে সর্বাধিক গতিতে মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করবে এ অঞ্চলের অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদরা এটির পূর্বাভাস দিয়েছেন দশমিক ৯ শতাংশ। ফলে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে পূর্ণ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা ধীরগতির টিকাদান কর্মসূচি এবং এক শতকের মধ্যে দ্রুততম মন্দার কালে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর পরিপ্রেক্ষিতে ভেস্তে যেতে পারে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার লেখটি হবে ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের আকৃতির। এর মধ্যে কিছু খাত এবং দেশ দ্রুত উন্নতির দিকে যাবে এবং অন্যদের অবস্থা হবে মৃতপ্রায়। বিশ্বব্যাপী জাতীয় আর্থিক প্রণোদনায় ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রণোদনার প্রস্তাব কেবল উপস্থাপন করা হচ্ছে মাত্র।

একই সময়ে কিছু সেবাদানকারী সংস্থা বলছে, তাদের হাতে বিকল্প খুব কম। কিন্তু ব্যবসা বাঁচাতে হলে সেবামূল্য বাড়াতেই হবে। যেখানে ভোক্তানির্ভর বহু কোম্পানি অত্যন্ত কম প্রান্তিক মুনাফায় পরিচালিত হচ্ছে এবং তাদের পণ্য বিক্রির পরিমাণের ওপর নির্ভর করতে হয়।

সব তথ্য-উপাত্তই বলছে, ইউরোজোনে ভোক্তানির্ভর সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলো সংকট কাটিয়ে উঠছে। তবে বর্তমানে খাতভিত্তিক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন হেয়ারড্রেসাররা বেশি ফি নিচ্ছেন, হোটেলগুলো ডিসকাউন্ট দিচ্ছে এবং রেস্টুরেন্টগুলো আছে স্থিতাবস্থায়।

একটা বিষয় নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে তর্ক চলছে সেটি হলো, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাকরি হারানোর নিরাপত্তা সহায়তা স্কিম (ফারলো) এবং বন্ড কেনায় বিপুল অর্থ ঢেলেছে—মহামারীর শেষে মানুষের মধ্যে এমন ধারণা যতটা না বিদ্যমান থাকবে পণ্য ও সেবার মূল্য তার চেয়ে বেশি বেড়ে যেতে পারে।

ক্রিপ্টোকারেন্সির আকাশচুম্বী উল্লম্ফন এবং রেডিট গ্রুপগুলোর অতি উৎসাহে শেয়ারবাজারে অভাবনীয় উত্থান-পতনে সেই বিতর্কের পালে হাওয়া পেয়েছে।

লকডাউনে কিছু মানুষ আয় উপার্জন ধরে রাখতে পেরেছে এবং খরচের খাত না থাকায় তাদের টাকা জমে গেছে। এ ধারণা সত্যি হলে মহামারীর পরে ভোক্তাব্যয় নিঃসন্দেহে বাড়বে।

ফ্রাঙ্কফুর্টের ট্রাভেল এজেন্সি প্ল্যানরাইজেনের স্বত্বাধিকারী মানবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, মানুষের আগ্রহের কিন্তু কমতি নেই। যদিও এখনই সেভাবে বুকিং শুরু হয়নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের মধ্যে ভ্রমণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এখানে মূল্য কিন্তু কখনো ব্যাপার ছিল না।

তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মহামারীর মধ্যে অর্থ সঞ্চয় সবাই করতে পারেনি। তাছাড়া কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা এখন অত্যন্ত বেশি। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক স্বীকার করেছে, মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিরবচ্ছিন্ন হবে না। যেমন জার্মানির মহামারীকালীন কর অবকাশ সময় শেষ হওয়া এবং জ্বালানি মূল্য বাড়তে শুরু করায় জানুয়ারিতে পণ্য ও সেবামূল্য বেড়েছে। সংকটকালের পরই মূল্যে নিম্নগামী প্রবণতা ফিরে আসবে।

ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর গড় মূল্যস্ফীতি ১ শতাংশে থাকবে। ২০২৩ সালে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশে ঠেকতে পারে। তার পরও এটি প্রত্যাশার (২%-এর কিছু কম) চেয়ে কম।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *