‘পরিযায়ী’ শ্রমিকদের প্রস্থানে সংকটে ভারতের কারখানা কার্যক্রম

কঠোর লকডাউন পদক্ষেপের পর ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ফিরতে চাইছে ভারত। এরই মধ্যে দেশটির বিভিন্ন স্থানে চেষ্টা চলছে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা কারখানাগুলোয় ফের কার্যক্রম শুরু করার। কিন্তু এক্ষেত্রে কারখানা মালিকদের বিপাকে ফেলছে শ্রমিক সংকট। বিশেষ করে লকডাউনের সময় বড় শহরগুলো থেকে দলে দলে গ্রামের বাড়ি ফিরে যান দেশটির ‘পরিযায়ী’ শ্রমিকরা। এখন তারা ফিরে না আসা পর্যন্ত ফের পূর্ণমাত্রায় কারখানা চালু করা সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। খবর এএফপি।

ভারতের বড় শহরগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের কাছে ভাগ্যবদলের জন্য বরাবরই আকর্ষণীয় গন্তব্য। রাজধানী দিল্লি, মুম্বাইসহ বড় শহরগুলোর কারখানায় কাজ করে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ভাগ্যান্বেষী লাখ লাখ মানুষ। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে লকডাউনের কারণে এদের অধিকাংশই কর্মহীন হয়ে পড়ে। উপার্জনহীন অবস্থায় প্রথমে সঞ্চয় খরচ করে চলে বাড়িভাড়া ও খাবারের জোগান। কিন্তু পরে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে তাদেরকে বাধ্য হয়ে নিজ নিজ গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিতে হয়। এখন গ্রামে ফিরে যাওয়া এসব শ্রমিক আদৌ জানেন না যে তারা আবার তাদের কর্মস্থলে যোগ দিতে পারবেন কিনা।

হরিয়ানা রাজ্যের অ্যাকুয়ালাইট ইন্ডাস্ট্রিজের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী সঞ্জীব খরবান্দা বলেন, তাদের জুতা তৈরির কারখানার ৬০ শতাংশ শ্রমিক বাড়িতে ফিরে গেছেন। এ অবস্থায় এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিক নিয়ে কোনোভাবেই উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব নয়। তাদের স্পোর্টস সু তৈরির ইউনিটটি দীর্ঘদিন ধরে অলস পড়ে আছে। ইউনিটটির অত্যাধুনিক যন্ত্রগুলো পরিচালনার জন্য কোনো দক্ষ শ্রমিক অবশিষ্ট নেই। তিনি বলেন, এখন আমরা শুধু একটি শিফট চালু রেখেছি। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু মুনাফা নেমে যাচ্ছে তলানিতে।

এদিকে গুজরাটের সুরাটে যেখানে বিশ্বের ৯০ শতাংশ হীরা কাটা ও পলিশ করা হয়, সেখানে সংশ্লিষ্ট বহু কারখানা শ্রমিক সংকটের কারণে চালু করা যাচ্ছে না। লকডাউনের সময় এখানকার শ্রমিকদের দুই-তৃতীয়াংশ বাড়ি ফিরে গেছেন বলে জানিয়েছেন সুরাট ডায়মন্ড অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট বাবু কাঠিরিয়া।

একইভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমিক সংকটে ভুগছে রাজ্যের লবণ পরিশোধনাগারগুলো। এরই মধ্যে শ্রমিকদের কাজে টানতে দ্বিগুণ মজুরির প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব শিগগিরই হয়তো শ্রমিকরা আর ফিরছেন না। এ বিষয়ে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সন্তোষ মেহরোত্র বলেন, সত্যি বলতে বহু ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের অবস্থান এমন সব রাজ্যে, যেখানে মহামারীর প্রভাব ছিল খুবই মারাত্মক। এর মধ্যে অন্যতম হলো তামিলনাড়ু, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও দিল্লি। এখন এসব অঞ্চল থেকে যে শ্রমিকরা বাড়ি চলে গেছেন, তারা স্বাভাবিকভাবেই শিগগিরই ফিরে আসার তাড়ায় নেই।

ভারতের অভ্যন্তরে এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে কিংবা বাড়ি থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে গিয়ে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ১০ কোটির মতো, যা দেশটির মোট শ্রমশক্তির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। মূলত তুলনামূলক স্বল্প মজুরিতে এসব শ্রমিক তৈরি পোশাক, নির্মাণ, খনি ও ক্ষুদ্র ব্যবসার মতো শিল্প খাতে কাজ করেন। কিন্তু কভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধে যখন ভারতে দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হলো, তখন তাত্ক্ষণিকভাবেই বহু শ্রমিক তাদের চাকরি হারান। এ অবস্থায় তারা বিপাকে পড়েন বাড়িভাড়া প্রদানসহ সার্বিক ব্যয় নির্বহনে। ফলে তারা বাধ্য হয়েই দলে দলে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। তবে এ ঘরমুখী যাত্রায়ও তাদেরকে চরম কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা বাধ্য হয়েছেন হেঁটে হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে। এতে পথেই মারা গেছে বহু মানুষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারীর আগেই এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারত বিপর্যয়ের মধ্যে ছিল। এখন শ্রমিক সংকট পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলছে। এরই মধ্যে সরকার অর্থনীতির সুরক্ষায় ২৬ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু অন্তত স্বল্পমেয়াদে এতে তেমন কোনো সুফল মিলবে না। অন্যদিকে ভয়ের বিষয় হলো, পরিযায়ী শ্রমকিদের এ প্রস্থান দেশটির অর্থনীতিকে অন্তত ১৫ বছর পিছিয়ে দিতে পারে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *