গত মঙ্গলবার থেকে প্যারিসের ক্যাফেগুলো চালু হয়েছে এবং ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক রাজধানীটি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বিভিন্ন বয়সী মানুষ এ সুযোগে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচছে। নভেল করোনাভাইরাসে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত দেশটি আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে লকডাউনে ছিল। পরবর্তীতে লকডাউন শিথিল হলেও ক্যাফে ও অতিরিক্ত জনসমাগমের জায়গাগুলো বন্ধ ছিল। ধাপে ধাপে লকডাউন শিথিলের অংশ হিসেবে মঙ্গলবার ক্যাফেগুলো খুলে দেয়া হয়েছে।
খাওয়া-দাওয়া ও ক্যাফে সংস্কৃতি প্যারিসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনেককেই বেশ পরিপাটি হয়ে ক্যাফেতে জমায়েত হতে দেখা গেছে। তাদের একজন ৮৮ বছর বয়সী ম্যাথিল্ডে। প্যারিসের একটি ক্যাফেতে পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে তিনি বলেন, আমি এটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যেখানে আমাদের চারপাশে মানুষ ঘিরে রাখবে। আমি আর বিচ্ছিন্ন থাকতে চাইছি না।
তবে এখনকার জনজীবন পুরোপুরি ভিন্ন। ক্যাফে ও রেস্তোরাঁগুলো চালু হলেও তারা বেশকিছু নিয়মকানুন কড়াভাবে অনুসরণ করছে। বসার জন্য থাকছে নতুন নিয়মকানুন, নতুন পরিষ্কার পদ্ধতি, যেখানেই আপনি নজর দেবেন, সেখানেই হ্যান্ড সানিটাইজারের উপস্থিতি দেখতে পাবেন।
চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ম্যাথিল্ডের সঙ্গে ক্যাফেতে আসা তার বান্ধবী অ্যানি (৭৮) বলছেন, অবশ্যই আমি ভয় পেয়েছি। তবে আমাদের বয়সে জীবনের তো আর বেশি দিন বাকি নেই! তাই এক পর্যায়ে আমাদের এভাবে প্রিয়জনদের সঙ্গ কাটাতে এভাবে বেরিয়ে আসতেই হবে।
প্যারিসের বার ও ক্যাফে আবার চালু হয়েছে বলে অনেকে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। লকডাউনের সময় ইউরোপের ব্যস্ততম এ শহরটিতে শূন্যতা দেখা দিয়েছিল। ফরাসি সংস্কৃতির লেখক ও ইতিহাসবিদ হুয়ান দেজেঁ বলেন, প্যারিস শহরটি আসলে পথচারী ও পর্যটকদের কথা মাথায় রেখেই সাজানো হয়েছে। উদ্যান থেকে শুরু করে সেন্ট লুইয়ের সুন্দর বাড়িগুলোয় যদি কোনো পথচারী না দেখেন, তবে তারা তাদের উপস্থিতির আবশ্যকতা হারিয়ে ফেলেন।
লকডাউন চলাকালে জনশূন্যতার প্রতীক হিসেবে দুটি শহর বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে—ভেনিস ও প্যারিস। প্যারিসে দীর্ঘদিনের বাসিন্দা ডেলফাইন অবশ্য লকডাউনকে ভিন্নভাবে দেখে বলছেন, আমি জনশূন্যতাকে আরো বেশি ভালোবাসি। আমরা অনেক পাখির ডাক শুনেছি। লকডাউন উঠে যাওয়ায় আমার ভয় হচ্ছে রাস্তায় মানুষের আবির্ভাবে পাখিরা ফের চলে যাবে।
ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত সমস্যাগুলোও ফিরে আসতে শুরু করেছে। বাড়ির আঙিনায় তার দুই মেয়ে যখন ফুটবল খেলছিল, তখন এক প্রতিবেশী জানিয়ে দিলেন, তিনি বাসা থেকে অফিস করছেন। এজন্য যেন শিশুরা কম গোলমাল করে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, লকডাউনে কিন্তু সব মানুষ নারাজ ছিল না। প্যারিসের কোচিন হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অ্যালান কাদৌরি জানান, বাস্তবে এত বিশালসংখ্যক মানুষ ঘরে থাকা জীবন পছন্দ করে, তা দেখে তিনি অবাক হয়েছেন।
তিনি বলেন, যারা সামাজিক সম্পর্ককে ভয় পান, তারা লকডাউনের সময় সুরক্ষিত বোধ করেছিলেন। যারা প্রেমের জীবনকে জটিল মনে করেন, তাদের সামনে কোনো প্রশ্ন ঝুলছিল না এবং কিশোর-কিশোরীরা বাড়িতে থেকে ইচ্ছেমতো ভিডিও গেমস খেলতে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকতে খুব মজা পেয়েছে।
তবে সাধারণ নাগরিক ও হাসপাতালের নার্সরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, সেটা একেবারেই ভিন্ন। লকডাউনের সময় প্রতি ১০ নার্সের মধ্যে একজনের ওপর আঘাত এসেছে। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় কাউকে কাউকে ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যেতে চাপ দিয়েছেন প্রতিবেশীরা।
এখন স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসায় তাদের কেউ কেউ ভেঙে পড়েছেন, কারণ তারা দ্বিতীয়বারের মতো (সেকেন্ড ওয়েভ) ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন। মনোবিজ্ঞানী কাদৌরি বলেন, আমি ত্রিশের কোটায় থাকা কয়েকজন নার্সের কাছ থেকে শুনেছি ইদানীং তাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছে।