দেশে ১৬ শতাংশ নাগরিক বিষণ্নতায় ভুগছে

দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি প্রতি বছরই বাড়ছে। এতে মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বাড়ছে। তবে মানসিক স্বাস্থ্য দৃষ্টির বাইরেই রয়েছে। বিভিন্ন সূচকে স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। দেশের নাগরিকদের বড় একটি অংশ বিষণ্নতায় ভুগছে। এতে শারীরিক স্বাস্থ্যের অবনতি ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে তারা। বছরের ব্যবধানে বিষণ্নগ্রস্ত নাগরিকদের আকার দাঁড়িয়েছে ১৬ শতাংশের বেশি।

বাংলাদেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছে। একই সঙ্গে ৬ শতাংশ উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যাগ্রস্ত বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। চলতি মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইন ফোকাস: ক্লাইমেট অ্যাফ্লিকশন’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করেছে। এর আগে ২০১৯ সালে প্রকাশিত সরকারের ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-১৯’ শীর্ষক গবেষণায় বিষণ্নতায় ভুক্তভোগীর সংখ্যা কম ছিল।

সরকারের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের প্রায় ১৭ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। আর এর মধ্যে ৭ শতাংশ (১৮ থেকে ৯৯ বছর বয়সী) নাগরিকের মধ্যে বিষণ্নতার ব্যাধি পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সব কয়টি জেলা থেকে সাত হাজারের বেশি ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে জরিপে।

অন্যদিকে চলতি মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ১৬ শতাংশের বেশি নাগরিকের মধ্যে বিষণ্নতা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬৫ ঊর্ধ্ব নাগরিকদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ বিষণ্নতা রয়েছে। ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী নারী ও পুরুষদের মধ্যে ৬ শতাংশ, ২৬ থেকে ৪০ বছরের ১২ শতাংশ এবং ৪১ থেকে ৬৫ বছরের নাগরিকদের ২২ শতাংশ বিষণ্নতায় রয়েছেন। নারী ও পুরুষদের মধ্যে বিষণ্নতার অবস্থা একই, যা শীতের সময়ে বৃদ্ধি পায়।

বিশ্বব্যাংক গবেষণাটিতে বলেছে, বিষণ্নতার কারণে বাংলাদেশের নাগরিকরা মানসিক রোগে স্থায়ীভাবে অসুস্থ হচ্ছেন। এতে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা ও প্রতিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র, বৃদ্ধ এবং শারীরিকভাগে অক্ষম ব্যক্তিদের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা দিচ্ছে।

২০১৯ ও ২০২০ সালে দুই দফায় তথ্য সংগ্রহ করে এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে সাত হাজারের বেশি পরিবারের প্রায় ৩০ হাজার ব্যক্তির তথ্য নেয়া হয়েছে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে কাঠামোগত এবং অনানুষ্ঠানিক প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে গবেষণা পরিচালনা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, বিষণ্নতা একটি চিকিৎসা উপযোগী অবস্থা। এটি কোনো বয়সের সঙ্গে স্বাভাবিক বিষয় নয়। ভালো মানসিক অবস্থা, সমস্যা মোকাবেলার সক্ষমতা এবং আবেগ-অনুভূতি, চিন্তাভাবনা, সামাজিক সম্পর্ক ও জীবন সম্পর্কে বোধগম্যতার মানসিক স্বাস্থ্য থেকে বিচ্যুতি ঘটছে। ব্যক্তির মনের সংকটাপন্ন অবস্থা, যা তার চিন্তা, অনুভূতি, আচরণ, পারস্পরিক সম্পর্ক ও দৈনন্দিন কাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে মানসিক সমস্যা তৈরি করছে।

বিষণ্নতার মতো মানসিক সমস্যা শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর খুবই প্রভাব ফেলে উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, বিষণ্নতার ফলে শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এতে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হূদরোগ, বাতজাতীয় বিভিন্ন রকমের ব্যথা, স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিবৈকল্যের মতো দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা তৈরি হয়।

মেজাজ ভালো না থাকা, কোনো বিষয়ে আগ্রহ-উদ্যম কমে গিয়ে সবসময় অবসাদ চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। মনোযোগের অভাব, মনের ভেতর অস্থিরতা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, নিজেকে সব কাজের জন্য অযোগ্য মনে করা, অকারণে বা সামান্য কারণে কান্না, নিজেকে অপরাধী মনে করা, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চরম হতাশাও কাজ করে। একই সঙ্গে ক্ষুধা, ঘুম ও যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে গিয়ে আত্মহত্যার পরিকল্পনাও উপসর্গের মধ্যে রয়েছে। সামাজিক, মানসিক ও জৈবিক কারণে বিভিন্ন বয়সের মানুষ বিষণ্নতার মধ্যে পড়ে। এতে যকৃৎ, বৃক্ক, হূিপণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে শরীরে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যায় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. মো. তাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, মস্তিষ্কে সমস্যার কারণে বিষণ্নতার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। বংশগত সমস্যা, আবেগ-অনুভূতির অসামঞ্জস্য, পেশাগত চাপ, বৈষম্য, নিপীড়নের ফলে বিষণ্নতার সৃষ্টি হয়। ২০৫০ সাল নাগাদ বিষণ্নতা দুরারোগ্য রোগের তালিকায় প্রথম স্থানে উঠে আসবে।

গবেষণায় বিষণ্ন মানুষের পরিসংখ্যানের চেয়ে বাস্তবতা আরো বেশি। বিষণ্নতা দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএমএ সালাহউদ্দীন কাউসার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হলে স্বাস্থ্যের অন্যান্য সূচকে এগিয়ে থাকলেও তাতে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে না। মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য প্রভাবকও ঠিক রাখতে হবে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *