আজ মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন। রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যার গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আজ নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনএলডি)।
দীর্ঘ ৫০ বছরের বিচ্ছিন্নতা ও সেনা শাসনের পর ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন হয় মিয়ানমারে, যাতে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী সু চি ও তার দল এনএলডি। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যজনিত সংকট আর রাখাইন ইস্যুর কারণে এবারের নির্বাচনটি গতবারের চেয়ে কিছুটা আলাদা। তবু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এবারো সু চিই ফেভারিট।
বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনের মানুষজনের আশা ছিল, মিয়ানমারের সত্যিকারের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজে সু চি দেশকে নেতৃত্ব দেবেন। নির্বাচনের পাঁচ বছর পর ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন সু চি এবং তার দল এনএলডি আরেকটি জয়ের দ্বারপ্রান্তে।
গণতান্ত্রিক আইকন হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বে সু চির যে জনপ্রিয়তা ছিল, এখন আর তা নেই। বিশেষ করে জাতিগত রাখাইন মুসলমানদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার ঘটনা সু চি যেভাবে সামাল দিয়েছেন, তা ভালোভাবে নেয়নি বিশ্ব। জাতিসংঘ একে বলছে ‘হলমার্কস অব জেনোসাইড’।
রাখাইন অঞ্চলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে অন্তত ৭ লাখ ৪০ হাজার মানুষ (যদিও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মতে, সংখ্যাটি প্রায় ১১ লাখ) সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। যারা পালিয়ে বেঁচেছে, তারা সেনাবাহিনীর লোমহর্ষক নৃশংসতার বর্ণনা দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গণধর্ষণ, গণহত্যা, নির্বাচন ও সম্পদের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ।
যেসব রোহিঙ্গা রাখাইনে রয়ে গেছে, তাদের বিচ্ছিন্ন করে বন্দিশিবিরের মতো একটি ক্যাম্পে রাখা হয়েছে, যেখানে যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ জন কুইনলে বলেন, রোহিঙ্গারা ভোটদানে সমর্থ নয়, এমনকি ১৯৮২ সালের বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন দিয়ে তাদের পূর্ণ নাগরিকত্বের অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভোটদান থেকে রহিত রাখার পাশাপাশি রোহিঙ্গা রাজনৈতিক নেতাদেরও এবার ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেয়া হয়নি। সেখানে অনেক সাহসী, স্মার্ট ও যোগ্যতাসম্পন্ন রাজনীতিকও রয়েছেন।
রোহিঙ্গারা নির্বাচনে ভোটদানে কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বঞ্চিত হলেও মিয়ানমারে এ নিয়ে মাথাব্যথা কম মানুষেরই। গত বছর নেদারল্যান্ডসের হেগে ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’-এ যখন গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে নিজ দেশকে সমর্থন করেন, তখনই পশ্চিমা বিশ্বে ‘স্বর্গ থেকে পতন’ হয়ে যায় এক সময়ের খ্যাতিমান মানবাধিকার নেত্রী সু চির।
অবশ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, মিয়ানমারে সু চির জনপ্রিয়তা বেড়েছে এবং এটাই আজকের নির্বাচনে তাকে পরিষ্কারভাবে এগিয়ে রাখছে।
সাংবিধানিক কারণে সু চি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি, তাই তার জন্য ‘স্টেট কাউন্সেলর’ পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। কার্যত তিনিই মিয়ানমারের শীর্ষ নেতা।
সেনা শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রায় দুই দশক গৃহবন্দি ছিলেন সু চি, সেই ভূমিকার কারণে দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা তৈরি হয় গুপ্তহত্যার শিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক অং সানের মেয়ের।
২০১৫ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সংবিধান সংশোধন আর রোহিঙ্গা ইস্যুতে শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর কথা বললেও প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেননি সু চি ও তার দল। যদিও এ নিয়ে ভাবছে না তার সমর্থকরা। ইয়াঙ্গুনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিচার্ড হোরসে বলেন, নির্দিষ্ট পলিসি নিয়ে তিনি কী করেছেন, তা এখানে বড় কোনো ভূমিকা রাখছে না। এ নির্বাচন ব্যক্তিত্বের, পলিসির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়।’
স্বাধীন নির্বাচন পর্যবেক্ষক ‘পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ক্রেডিবল ইলেকশনস’ ২০২০ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখতে পেয়েছে, ৭৯ শতাংশ জনগণ সু চির ওপর আস্থা রাখছে।
এছাড়া সু চিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো শক্ত দলও নেই। ৯১টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তার একটিও এনএলডির জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারছে না। সিএনএন