‘জুম অবসাদে’ ভুগছে মানুষ

মনে করুন কর্মক্ষেত্রে সময়ে সময়ে আপনাকে এদিক-ওদিক যেতে হচ্ছে। আপনার সহকর্মী একটি আয়না ধরে রেখেছে, যেখানে আপনার আসা-যাওয়ার সময় বারবার চোখ পড়ছে। প্রায় প্রতিবারই নিজের বেশভূষার দিকে এক পলক হলেও তাকিয়ে দেখছেন আপনি। এভাবে আপনার দিনের একটা বড় সময়ই নিজের দিকে তাকাতে তাকাতেই চলে যাচ্ছে, যা আপনার কর্মক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। কাজের ক্ষেত্রে আপনার মনসংযোগের ঘাটতি পড়ছে এ অপ্রয়োজনীয় কাজের মাধ্যমে।

করোনাভাইরাসের কারণে শারীরিক দূরত্বের ভিডিও কনফারেন্স বর্তমানে যেন সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন-রাতের বড় সময়জুড়ে ভিডিও কনফারেন্সে অনর্গল সংযুক্তি ‘জুম ফ্যাটিগ’ বা ‘জুম অবসাদের’ দিকে মানুষকে ঠেলে দেয় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশন বিভাগের অধ্যাপক জেরেমি বেলেনসনের এক গবেষণায় এমনটিই বলা হয়েছে। গবেষণার পিয়ার-রিভিউতে অভূতপূর্ব ও মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ভিডিও আলাপের ফলাফলগুলো নিবন্ধ করা হয়। ভিডিও চ্যাটের ফলে দীর্ঘক্ষণ ধরে চোখের ক্লোজ যোগাযোগ এবং ব্যক্তির নিজের প্রতিবিম্ব বারবার দেখার নেতিবাচক প্রভাবগুলো উঠে আসে রিভিউতে। ‘টেকনোলজি, মাইন্ড অ্যান্ড বেহেভিয়ার’ শীর্ষক জার্নালে তা প্রকাশিত হয়।

‘বিবিসি রেডিও ৪’কে দেয়া এক বক্তব্যে বেলেনসন বলেন, এক দশক ধরে চলা মনস্তাত্ত্বিক এ গবেষণায় দেখা যায়, যখন আমরা আমাদের দিকে তাকাই, তখন আমরা আমাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। দেখার মাধ্যমে নিজেদের মূল্যায়ন করতে শুরু করে দিই। মাত্রাতিরিক্ত এমনটা ঘটলে নিজের ওপর চাপ বাড়ে, সেই সঙ্গে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়।

তিনি বলেন, যখন কোনো রিয়েলটাইম ভিডিও কিংবা আয়নায় আমরা আমাদের দেখি, তখন আমরা নিজেদের একটি আদর্শরূপ মানুষ হিসেবে কল্পনা করি। অর্থাৎ আমরা নিজেদের চোখে নিজেদের সেরা সর্বশ্রেষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভাবতে থাকি। কিন্তু বিপরীতে আমরা একটি নেতিবাচক ফল ভোগ করি।

বেলেনসনের মতে, জুমের নেতিবাচক প্রভাব হলো জুম থেকে বের হয়ে বাস্তবে যখন আমরা অন্য কোনো লোকের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করি, তিনি যখন আমাদের খুবই নিকটে চলে আসেন, তার চাহনির মাধ্যমে মস্তিষ্ক (ব্রেইন) আমাদের মধ্যে দুই ধরনের ভাবের উদ্রেক করে। এর মাধ্যমে মস্তিষ্ক একদিকে যেমন তাদের বন্ধু ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে, বিপরীতে বিরোধের ভাবেরও উদ্রেক করে। তিনি বলেন, আমরা যত বেশি সময় ধরে জুমে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত থাকি, ততটা সময় এই ‘হাইপার-অ্যারাউজড স্টেট’ মধ্যে আটকে থাকি।

তবে সমস্যার পাশাপাশি গবেষণায় এর সমাধানের পথও দেখিয়েছেন বেলেনসন। তার মতে, কিছু সহজ উপায় অবলম্বন করলেই এর তীব্রতা এবং এর মাধ্যমে সৃষ্ট অনিবার্য আলস্য থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি। এজন্য কম্পিউটার বা মোবাইলের ভিডিও চ্যাট উইন্ডোর সাইজ কমিয়ে রাখতে হবে। ফুল স্ক্রিন ব্যবহার করা যাবে না। একই সঙ্গে স্ক্রিনটাকে একটু বেশি দূরত্বে রাখার জন্য কি-বোর্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া ভিডিওতে দেখা অংশগ্রহণকারীদের মুখগুলো ‘লিস্ট ভিও’ এর পরিবর্তে ‘গ্রিড ভিও’ মুডে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

তবে বিশেষভাবে কেউ চাইলে ডিফল্ট সেটিংস পরিবর্তন করে ‘হাইড সেল্ফ ভিউ’ বাটন ব্যবহার করে নিজের ছবি/ভিডিও দেখা বন্ধ করতে পারেন। এছাড়া কেউ চাইলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের ক্যামেরা বন্ধ করে দিতে পারেন। চাইলেই এর মাধ্যমে নিজেকে ‘নন-ভার্বাল রেস্ট’ দিতে পারেন তারা।

তবে এতে কেবল ক্যামেরা বন্ধ করে কথাবার্তা না বলে মিটিংয়ে অ্যাকটিভ থাকা বোঝায় না। বরং হাইড-ভিউি বাটনের মাধ্যমে আপনি কেবল আপনার শরীর বা চেহারাকে স্ক্রিন থেকে সরিয়ে নিলেন। যাতে কিছু সময়ের জন্য আপনার নড়াচড়া নিজের জন্যই খুব একটা সমস্যার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। অন্যদিকে মিটিংয়ের একটা বড় সময় ধরে কথা না বলে শুধু শ্রোতা হয়ে মিটিংয়ে থাকাটা এক অর্থে বাস্তবসম্মত হতে পারে, কিন্তু সামাজিকভাবে তা অর্থহীন। কারণ তাতে আপনার থেকে কেউ কোনো উপকার পাচ্ছে না। অর্থাৎ মিটিংয়ে আপনার থাকা না থাকা উভয় সমান।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *