চোরাচালানের সঙ্গে বেড়েছে সীমান্ত হত্যা

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের উৎমা সীমান্ত দিয়ে গত শনিবার দুপুরে অবৈধভাবে ভারতে ঢুকে পড়েন দুই বাংলাদেশী। তাদের দেখে গুলি ছুড়ে স্থানীয় খাসিয়ারা। গুলিতে মারা যান বাবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তি। আহত হন আরেকজন। অভিযোগ রয়েছে, সুপারি চুরির উদ্দেশ্যে ভারতের খাসিয়াপুঞ্জিতে এক সঙ্গীসহ গিয়েছিলেন বাবুল। চুরির সময় স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের গুলি করে।

সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে এ রকম ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। বিশেষত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর বেড়েছে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ, চোরাচালান ও সীমান্ত হত্যার ঘটনা। গত এক মাসে সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের গুলিতে মারা গেছে অন্তত পাঁচ বাংলাদেশী। গুলিবিদ্ধ হয়েছে আরো অন্তত ১০ জন।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, করোনার প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েছে সীমান্ত এলাকার মানুষ। বন্ধ রয়েছে সীমান্ত দিয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। সীমান্ত হাটগুলোও বন্ধ। এ কারণে গত তিন মাসে সিলেটের সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাচালান বেড়েছে। করোনা ও বন্যার কারণে সীমান্তে বিজিবির টহলও আগের থেকে কিছুটা সীমিত হয়ে এসেছে। এই সুযোগও নিচ্ছে চোরাকারবারিরা। চোরাচালান বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে সীমান্ত হত্যাও।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম আহমদের মতে, সীমান্ত হাটগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া ও আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বিভিন্ন পণ্য আনতে অনেকেই অবৈধভাবে ভারত চলে যাচ্ছে। তিন-চার মাস ধরে এমন প্রবণতা বেড়েছে।

শামীম আহমদ বলেন, করোনা সংক্রমণের ভয়ে ভারতীয় খাসিয়ারা নিজেদের গ্রামে অন্য কাউকে ঢুকতে দেয় না। তাই লুকিয়ে কেউ ঢুকে পড়লেই তারা গুলি ছোড়ে।

এর আগে ২ জুলাই গোয়াইনঘাট সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়ার গুলিতে সিরাজ উদ্দিন, ২৮ জুন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে জুয়েল মিয়া, ২০ জুন কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তে খাসিয়াদের গুলিতে বাবুল বিশ্বাস ও ১০ জুন গোয়াইনঘাট সীমান্তে খাসিয়াদের গুলিতে মিন্টু মিয়া মারা যান। এছাড়া ২৩ মে গোয়াইনঘাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে কালা মিয়া নামে আরেক যুবক মারা যান।

বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, তারা প্রত্যেকেই অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সুপারিসহ বিভিন্ন সামগ্রী চুরির সময় তাদের গুলি করা হয়।

বিজিবির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, গত মে থেকে সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুরসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে গরু ও সুপারি চোরাচালান, আনারস, কাঁঠাল চুরি ইত্যাদির জন্য সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে ভারতে প্রবেশের মাত্রা বেড়েছে।

করোনায় কর্মহীনতার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন বিজিবির কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সীমান্তবর্তী এলাকার জনসাধারণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের স্বাবলম্বী করা না গেলে এ প্রবণতা ঠেকানো কঠিন হবে।

তবে স্থানীদের অভিযোগ, টহলে শিথিলতা ও বিজিবির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই বেশির ভাগ চোরাচালানের ঘটনা ঘটে থাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সংগ্রাম পুঞ্জি, বিছনাকান্দি, মাতুরতল, জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল ও সুরাইঘাট, ডিবিরহাওড় এবং কানাইঘাট, জকিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে সব সময়ই চোরাচালান হয়। এসব সীমান্ত দিয়ে গরু, মাদক ও সিগারেট চোরাচালান চলে আসছে অনেক দিন থেকেই। সাম্প্রতিক সময়ে করোনার প্রভাবে বেড়েছে চোরাচালান। এখন সুপারি-আনারসের মতো পণ্য চুরি করতেও অনেকে অবৈধভাবে চলে যাচ্ছে ভারতে।

এ প্রসঙ্গে বিজিবির ৪৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আহমেদ ইউসুফ জামিল, পিএসসি বলেন, সীমান্ত এলাকার বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র। তারা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। করোনার কারণে অনেকেরই কাজ নেই। ওই এলাকাগুলোর কর্মসংস্থানের অন্যতম ক্ষেত্র পাথর ও বালি উত্তোলন। করোনা ও বন্যার কারণে এগুলো বন্ধ রয়েছে। সীমান্ত দিয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমও বন্ধ। ফলে স্থলবন্দরগুলোয় যারা কাজ করত, তারাও কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এ কারণে অনেকেই চুরির উদ্দেশ্যে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে ভারতে ঢুকে পড়ছে।

তিনি বলেন, করোনার ঝুঁকি নিয়েই বিজিবি সদস্যরা সীমান্তে টহল দিচ্ছেন। বন্যায় আমাদের অনেক চৌকি পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব কারণে কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। তবে বন্ধ হয়নি।

আহমেদ ইউসুফ জামিল বলেন, সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক কর্মসংস্থান ও জনসচেতনতা তৈরি ছাড়া অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো অনেকটাই অসম্ভব।

যদিও চোরাচালান ও অবৈধ অনুপ্রবেশ বাড়েনি বলে দাবি করেছেন গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুস সাকিব। তিনি বলেন, অবৈধ অনুপ্রবেশ আগেও ছিল। কিন্তু আগে এত গুলি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটত না। কেউ অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করলে ভারতীয়রা তাদের আটকে রাখত। হেনস্তা করত। পরে ফিরিয়ে দিত। কিন্তু এখন করোনার ভয়ে দেখলেই গুলি করছে। ফলে সীমান্ত হত্যা বেড়েছে।

তিনি বলেন, চোরাচালান বরং আগের তুলনায় কমেছে। কারণ ভারতে লকডাউনের কারণে চোরাকারবারিরা পণ্য আনতে পারছে না।

সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও সীমান্ত হত্যা বেড়ে যাওয়ায় এসব প্রতিরোধে ৪ জুলাই গোয়াইনঘাট সীমান্তে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবির যৌথ উদ্যোগে সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

সমাবেশে বক্তারা যেকোনো মূল্যে সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মাদক, চোরাচালান, অনুপ্রবেশসহ অবৈধ সব তত্পরতা বন্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

সীমান্তে চোরাচালান ও হত্যা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, সিলেটের সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে গাছ থেকে সুপারি, লাকড়ি, আনারস কিংবা পাথর আনতে গিয়ে অনেকেই হতাহত হচ্ছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *