চীনের রেকর্ড আমদানিতে মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা

মহামারীর ধাক্কা সামলে উঠেছে চীন। লকডাউন তুলে নেয়া হয়েছে দেশটির আর্থিক ও শিল্প খাতগুলো থেকে। এতে দেশটির অর্থনৈতিক গতি স্বাভাবিক হয়েছে। ফলে চীনজুড়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের চাহিদা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সঙ্গে বেড়েছে আমদানিও। এ ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের মে মাসে দেশটিতে জ্বালানি পণ্যটির আমদানি বেড়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এদিকে বিশ্বের শীর্ষ অপরিশোধিত জ্বালানি তেলে ভোক্তা দেশটির রেকর্ড আমদানিতে পণ্যটির দাম বাড়তে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতি তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ওপেকের নীতিনির্ধারণে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। খবর ব্লুমবার্গ ও এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটস।

চীনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় দেশটির অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি ১৯ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে এ-যাবত্কালের সর্বোচ্চে উঠেছে। এ সময়ে দেশটি দৈনিক গড়ে ১ কোটি ১৩ লাখ ৪০ হাজার ব্যারেল বা মোট ৪ কোটি ৭৯ লাখ ৭০ হাজার টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করেছে।

চীনের জ্বালানি তেল আমদানির এ তথ্য অর্গানাইজেশন অব এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (ওপেক) ও এর মিত্রদেশগুলোর জন্য চলতি প্রান্তিকের করণীয় নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। ৬ জুন চলমান চুক্তির মেয়াদ এক মাস বাড়িয়েছে জোটটি। বর্তমান চুক্তি অনুসারে ওপেক প্লাসের সদস্য দেশগুলো সম্মিলিতভাবে সক্ষমতার তুলনায় দৈনিক গড়ে ৯৭ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল উত্তোলন কমিয়ে দিয়েছে, যা মোট বৈশ্বিক সরবরাহের ১০ শতাংশ।

এদিকে চীনে চাহিদা বৃদ্ধি ও ওপেকের বিদ্যমান চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর জেরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজারে উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। টানা ছয়দিন ঊর্ধ্বমুখী ভাব দেখা গেছে পণ্যটির বাজারে। বর্তমানে পণ্যটির প্রতি ব্যারেল ৪০ ডলারের ওপরে অবস্থান করছে, যা বছরের শুরুর দিকের দাম অপেক্ষা অর্ধেকের বেশি। তবে সর্বশেষ কার্যদিবেস আগের দিনের তুলনায় জ্বালানিটির দাম কিছুটা কমতির দিকে থাকতে দেখা গেছে।

এ পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস সম্প্রতি চলতি বছরে জ্বালানি তেলের দামের পূর্বাভাসে সংশোধন এনেছে। প্রতিষ্ঠানটি আগের তুলনায় পণ্যটির দামের পূর্বাভাস বাড়িয়েছে। তবে ব্যাংকটি এ সময়ে সতর্ক করে দিয়ে জানিয়েছে, চাহিদার অনিশ্চয়তা ও দেশে দেশে মাত্রাতিরিক্ত মজুদের কারণে আগামী সপ্তাহগুলোয় পণ্যটির দাম কিছুটা কমে আসতে পারে।

চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে মে মাসে চীনের জ্বালানি তেল আমদানির পেছনে পণ্যটির সাশ্রয়ী মূল্য অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। নভেল কেরানাভাইরাসের ধাক্কায় বছরের শুরুতেই জ্বালানি তেলের বাজার নিম্নমুখী হতে শুরু করে। এছাড়া মতানৈক্যের জেরে পণ্যটির মূল্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সৌদি আরব ও রাশিয়া। একদিকে মহামারীর প্রাদুভার্বে রেকর্ড চাহিদা হ্রাস, অন্যদিকে দুই শীর্ষ উত্তোলনকরী দেশের মধ্যকার মূল্যযুদ্ধ—সব মিলিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে পণ্যটির বাজার। লাফিয়ে লাফিয়ে কমতে শুরু করে পণ্যটির দাম। এদিকে দরপতনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে চীনসহ অনেক দেশ পণ্যটির আমদানি বৃদ্ধিতে জোরারোপ করে। চীনের সরকারি ও বেসরকারি উভয় কোম্পানিই মার্চের শেষ দিকে মে মাসে সরবরাহ চুক্তিতে জ্বালানি তেলের প্রাক-ক্রয়াদেশ যথাসম্ভব বাড়িয়ে দেয়। এতে মে মাসে দেশটির বন্দরগুলোয় রেকর্ড জ্বালানি তেল পৌঁছে।

এদিকে আমদানির সঙ্গে গত মাসে চীনে জ্বালানি তেলের পরিশোধন কার্যক্রমও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের জেরে জানুয়ারির শেষ দিকে চীনের প্রায় সব ধরনের শিল্প ও আর্থিক খাত লকডাউনের আওতাভুক্ত হয়। এতে দেশটির জ্বালিনি তেলের পরিশোধন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। তবে পরিস্থিতিটি পাল্টেছে। শিল্প ও বাজারসংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে দেশটিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের অন্তঃপ্রবাহও আগের সর্বোচ্চ রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। এর আগে ২০১৯ সালের নভেম্বরের দেশটি দৈনিক গড়ে ১ কোটি ১১ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল পরিশোধন করে রেকর্ড করেছিল। গত মাসে এর তুলনায় পণ্যটির পরিশোধন ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।

এদিকে মে মাসে চলতি বছরের আগের মাসের তুলনায় চীনের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি বেড়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এপ্রিলে দেশটি দৈনিক ভিত্তিতে গড়ে ৯৮ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল জ্বালানি তেল আমদানি করেছিল। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে দেশটিতে পণ্যটির আমদানি দৈনিক গড়ে ১ লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল বেড়েছে। এর আগে গত মার্চে দেশটিতে জ্বালানি পণ্যটির আমদানি কমে আট মাসের সর্বনিম্নে ঠেকেছিল। নভেল করোনাভাইরাসের পূর্ণ প্রকোপের মধ্যে মার্চে চীন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দৈনিক গড়ে ৯৭ লাখ ২০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছিল। সে হিসাবে দেশটিতে ধীরে ধীরে পণ্যটির চাহিদা ও আমদানি বাড়ছে। এ নিয়ে বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত (জানুয়ারি-মে) চীন দৈনিক গড়ে ১ কোটি ৪ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *