গেটস-জবসের তিন দশকের লড়াই!

অনেকটা একই সময় কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিল গেটস ও স্টিভ জবস, যা ছিল প্রকৃতিগতভাবে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম দুই প্রযুক্তি জায়ান্টের সহপ্রতিষ্ঠাতাদ্বয়ের মধ্যে যেমন অনেক সময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, তেমনি বেশির ভাগ সময় একে অন্যের গলার কাঁটা ছিলেন। স্টিভ জবস প্রকাশ্যে বিল গেটসের স্বাদ এবং কল্পনা বিষয়ে বিদ্রূপ করতেন। বিল গেটসও স্টিভ জবসকে মানুষ হিসেবে ‘অদ্ভুতভাবে ত্রুটিযুক্ত’ বলতেন। তবে জীবনের একটা পর্যায়ে পরিপক্বতার দিক থেকে প্রযুক্তি খাতের দুই মহারথীকে খুব কাছাকাছি পৌঁছতে দেখা গেছে। ২০১১ সালে স্টিভ জবসের মৃত্যুর পর বিল গেটস বলেছিলেন, ‘তীব্র প্রতিযোগী হলেও তারা একে অপরকে দারুণভাবে উৎসাহিত করতেন।’

বিল গেটস ও স্টিভ জবস সর্বদা পরস্পরের শত্রু ছিলেন না। এর প্রমাণ শুরুর দিকে অ্যাপলের ব্যাপক জনপ্রিয় ‘অ্যাপল ২’ পার্সোনাল কম্পিউটারের সফটওয়্যার উন্নয়ন করেছিল মাইক্রোসফট। ওই সময় বিল গেটস নিয়ম করে কুপার্টিনোয় যেতেন অ্যাপল কী করছে তা পরখ করতে।

গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুর দিকে স্টিভ জবস ওয়াশিংটন পৌঁছেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের বৈপ্লবিক গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস নিজেরা উন্নয়নের জন্য মাইক্রোসফটের সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার বিভাগ ক্রয়ের প্রস্তাব দেয়া। কিন্তু জবসের এমন প্রস্তাবে খুশি হননি বিল গেটস। ওই ঘটনার পর বিল গেটস ও স্টিভ জবসের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়।

অ্যাপল ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার উন্নয়নের পরবর্তী কয়েক বছর মাইক্রোসফট ও অ্যাপল হাতে হাত রেখে কাজ করেছে। একটা পর্যায়ে বিল গেটস অনুধাবন করেছিলেন ম্যাক কম্পিউটার নিয়ে স্টিভ জবসের চেয়ে তার বেশি সংখ্যক মানুষ কাজ করছেন। গেটস ও জবসের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের শুরু সেখান থেকে। ১৯৮৫ সালে মাইক্রোসফট যখন উইন্ডোজের প্রথম সংস্করণ উন্মোচন করে, তখন দুই প্রযুক্তি মহারথীর সম্পর্কে চিড় ধরে। ওই সময় স্টিভ জবস নিজের উদ্ভাবন ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ নষ্টের চেষ্টার জন্য বিল গেটস এবং মাইক্রোসফটকে দায়ী করেছিলেন। বিষয়টি আমলে নেননি বিল গেটস।

স্টিভ জবস যখন বিল গেটসের বিরুদ্ধে গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেসের ধারণা চুরির অভিযোগ করেন, তখন গেটস জবাবে বলেছিলেন, ‘দারুণ স্টিভ, আমি মনে করি গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেসের ধারণা চুরির বিষয়ে অভিযোগ করার একাধিক পন্থা রয়েছে। ভুলে যাওয়া উচিত নয় আমাদের উভয়েরই জেরক্স নামে এক ধনী প্রতিবেশী রয়েছে। আমি টিভি সেট চুরি করতে তার বাড়িতে প্রবেশ করি এবং জানতে পারি যে সেখান থেকে গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেসের ধারণা তুমি আগেই চুরি করেছো।’

ওই ঘটনার পর থেকে মাইক্রোসফট এবং অ্যাপলের সহপ্রতিষ্ঠাতাদ্বয়ের অভিযোগ ছোড়াছুড়ি অনেকটা বন্ধ ছিল। এরপর জবস একবার বলেছিলেন, বিল গেটসের কোনো লজ্জা নেই। সে কৌশলে আমাদের ধারণা হাতিয়ে নিতে পেরেছে। এমন মন্তব্যের প্রতিবাদে গেটস বলেছিলেন, জবস যদি সত্যিই এমন মন্তব্য করে থাকে, তাহলে সে সত্যিই তার নিজস্ব বাস্তবতার বিকৃত একটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে।

স্টিভ জবস বেঁচে থাকা অবধি পরস্পর বাগবিতণ্ডায় লেগে থাকলেও অ্যাপল পণ্যে জবসের ডিজাইনের ভক্ত ছিলেন বিল গেটস। এ বিষয়ে গেটস বলতেন, প্রযুক্তি সম্পর্কে জবস কখনই ভালো কিছু জানে না। তবে তার এক আশ্চর্য প্রবৃত্তি ছিল। সেটা হলো মানুষের মধ্যে কোনটা কাজ করবে, তা ধরতে পারা।

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে খুব খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল অ্যাপল। ওই সংকটপূর্ণ সময়ে অ্যাপলে প্রত্যাবর্তন করেন স্টিভ জবস। মাঝে কিছু সময় তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত ছিলেন। প্রত্যাবর্তনের পর বিল গেটস নিজে থেকে আগ্রহী হয়ে স্টিভ জবস ও অ্যাপলকে খারাপ সময় কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এরপর আইফোন, আইপ্যাড ও চমকপ্রদ কম্পিউটিং ডিভাইস উন্মোচনের মধ্য দিয়ে অ্যাপল এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। স্টিভ জবসের অবর্তমানেও থেমে নেই অ্যাপলের অগ্রগতি। বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) টিম কুকের নেতৃত্বে স্বমহিমায় এগিয়ে চলছে অ্যাপল। ২০১৮ সালেই নাম উঠেছে ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান তালিকায়।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *