করোনায় লণ্ডভণ্ড ‘ক্রিকেট-২০২০’

হাতে সোনার ট্রফি উঁচিয়ে উল্লাসে মাতোয়ারা লাল-সবুজের জার্সি পরা একদল তরুণ। মাথায় তাদের বিশ্বকাপ জয়ের মুকুট। ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম আইসিসি ট্রফি জিতেছে আকবর আলীর দল। হ্যাঁ, অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল লিখেছে রূপকথার গল্প। ২০২০ এর শুরুটা তো এমনই আলোয় ঝলকানো! সারা বছর আরো কত অর্জনের আশা। কিছু সাফল্য, ব্যর্থতা আর হতাশার ‘২০১৯’ কে বিদায় বলে যেন নতুন বছরের শুরুতে স্বস্তির নিঃশ্বাস। যুবাদের জিতে আনা স্বপ্ন অনুপ্রেরণা হয়ে ছড়িয়ে গেছে দেশের পুরুষ ও নারী ক্রিকেটে। তাই আরো কত যে সাফল্যের অপেক্ষা! জাতীয় দলের সামনে ১০ টেস্ট, ৬ ওয়ানডে ম্যাচ খেলার সুযোগ।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তাই ২০ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার সূচি। কিন্তু হঠাৎ করেই হানা দিলো অদৃশ্য ভাইরাস। প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ ভাইরাসে মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের ক্রিকেট স্থগিত হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ধীরে ধীরে করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৭ মাস পর মাঠে ক্রিকেট ফেরায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তবে ততদিনে এর প্রভাবে বদলে গেছে ক্রিকেটের অনেক নিয়ম কানুন। টাইগারদের শুরুটায় ছিল ব্যক্তিগত অনুশীলন। এরপর অক্টোবরে বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপ ওয়ানডে। এই টুর্নামেন্ট যেন করোনার সঙ্গে লড়াই করে ব্যাট-বলের জয়। সেই সাফল্যে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের জমজমাট লড়াই দেখতে পায় মাঠে টাইগারদের ক্রিকেটের ভক্তকূল। এবার নতুন বছরের শুরুতেই ফের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার মিশন। করোনার ক্ষত পুষিয়ে নিতে এবার মুখোমুখি লড়াই-
রূপকথায় যুবদল
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে রূপকথার গল্প হয়ে থাকবে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের এবারের কীর্তি। যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ নাম জুড়ে আছে এমন আসরে বাংলাদেশের কোনো দলের সেরা সাফল্য এটি। আকবর আলী, পারভেজ হোসেন ইমন, শরিফুল ইসলামরা রাতারাতি বনে যান তারকা। বিপুল উন্মাদনায় বাংলাদেশের মানুষ বরণ করে তাদের।
অধিনায়ক মাশরাফির বিদায়
২০১৯ বিশ্বকাপেই মাশরাফির অবসরে যাওয়ার গুঞ্জন ছিল। তবে সে বছর তিনি বদলাননি নিজের অবস্থান। শোনা যাচ্ছিল তিনি দেশের মাটিতেই ক্রিকেটকে বিদায় বলবেন। তবে সেটিও হয়নি। মাশরাফি টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বললেও এখনো ওয়ানডে খেলার স্বপ্ন দেখেন। তাই শুধু ঘোষণা দিলেন নেতৃত্ব ছাড়ার। মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিলেটে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলছিল বাংলাদেশ। শেষ ওয়ানডের আগে আকস্মিকভাবে দেশের সফলতম অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা জানিয়ে দেন- খেলা চালিয়ে গেলেও অধিনায়কত্ব ছাড়ছেন তিনি। তার এই ঘোষণার পর আবেগ বয়ে যায় দল জুড়ে। সতীর্থদের কাঁধে চেপে নায়কোচিত এক বিদায় পান মাশরাফি।
লকডাউনে উন্মুক্ত ক্রিকেটের মানবতা
মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের ক্রিকেট বন্ধ হয়ে যায়। করোনা ভাইরাস মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। দেশের স্কুল-কলেজ থেকে সরকারি- বেসরকারি সব অফিস আদালত প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। লকডাউনের কারণে কর্ম হারায় অনেক মানুষ। এমন অবস্থায় ক্রিকেটে উন্মুক্ত হয় মানবতার অনন্য নজির। জাতীয় দলের প্রায় সব ক্রিকেটার নিজেদের সাধ্যের মধ্যে পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ান। মুশফিকুর রহীম, তাসকিন আহমেদ, সৌম্য সরকাররা নিজেদের প্রিয় ব্যাট বল নিলামে তুলে মানুষের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবাল, নাজমুল ইসলাম অপু, রনি তালুকদার, মোহাম্মদ মিঠুন এমনকি নারী দলের তারকা ক্রিকেটাররা তাদের অর্থ ব্যয় করে মানুষের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন। যে মানুষের জন্য তারা ক্রিকেট খেলেন তাদের বিপদে ক্রিকেটাররা চুপ করে বসে থাকতে পারেননি।
তামিমের অপেক্ষা
মাশরাফি ওয়ানডে নেতৃত্ব ছাড়ার পর থেকেই শুরু হয় গুঞ্জন। কে হচ্ছেন নয়া অধিনায়ক! সাকিব নিষিদ্ধ ছিলেন। মাহমুদুল্লা টি-টোয়েন্টি দলের নেতৃত্বে আছেন। সাবেক অধিনায়ক মুশফিকর রহীম জানিয়েছেন তিনি আর নেতৃত্ব গ্রহণে আগ্রহী নয়। তাই শেষ ভরসা ছিল তামিম ইকবাল। যদিও অভিজ্ঞ এই ওপেনারও শুরুতে রাজি ছিলেন না নেতৃত্ব নিতে। আলোচনার এক পর্যায়ে দীর্ঘ মেয়াদে অধিনায়কত্বের আশ্বাস পেয়ে দলের নেতৃত্বভার নিতে রাজি হন তামিম। মাশরাফি নেতৃত্ব ছাড়ার দুদিন পর (৮ মার্চ) তামিমকে ওয়ানডে অধিনায়ক ঘোষণা করে বিসিবি। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর তামিম কোনো আন্তর্জতিক ওয়ানডে ম্যাচে দলের নেতৃত্ব দিতে পারেননি। এখন তার অপেক্ষা নতুন বছরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের জন্য।
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সাকিবের ফেরা
জুয়াড়ির প্রস্তাব গোপন করে ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর সব ধরনের ক্রিকেটে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন সাকিব আল হাসান। এই বছর অবধারিতভাবেই ফেরেন তিনি। নিষেধাজ্ঞার সময়টায় অনেক ম্যাচ হারানোর মুখে ছিলেন সাকিব। কিন্তু করোনা এক অর্থে তাকে দিয়েছে স্বস্তি। তিনি নিষিদ্ধ থাকাকালে করোনায় বেশিরভাগ সময় বন্ধ ছিল সারা দুনিয়ার খেলাই। ফেরার পর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে খেলেছেন ওয়ানডের শীর্ষ অলরাউন্ডার। বোলিংয়ে কিছু নৈপুণ্য দেখালেও আট ম্যাচ খেলে নিষ্প্রভ ছিলেন ব্যাট হাতে। ফেরার পর কোয়ারেন্টিনের নিয়ম না মেনে ঢাকায় এক শপিং মলের উদ্বোধনে হাজির, কলকাতায় এক পূজার উদ্বোধনে গিয়ে উগ্রবাদীদের হুমকি পাওয়ার পর উলটো তা অস্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে চরম বিতর্কিত ও সমালোচিতও হন এই তারকা।
রেকর্ড বুকে লিটন দাস
খেলারই সুযোগ ছিল না বছর জুড়ে। তাই আহামরি কোনো রেকর্ডের সুযোগও ছিলনা টাইগারদের। তবে স্মরণীয় কিছু ঘটনা তবু ঘটেছে এই বছরে। মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ১৭৬ রানের ইনিংস খেলেন লিটন দাস। যা ছিল আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে বছরের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসও। ওই সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই নিজের আগের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়েছিলেন তামিম। এক ম্যাচের ব্যবধানেই তা কেড়ে নেন লিটন। এই বছরেই বিসিএলের ম্যাচে অপরাজিত ৩৩৪ রান করে তামিম প্রথম শ্রেণিতে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের হয়ে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলেন।
আশায় গুড়েবালি
বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান জাতীয় দলের নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমন জানিয়ে দিলেন ২০২০ হলো আশা ভঙ্গের বছর। তিনি বলেন, ‘দেখেন বছরের শুরুতেই কত আশা ছিল আমরা অনেক টেস্ট খেলবো। টি-টোয়েন্টি বিশ্‌্বকাপ খেলবো। কিন্তু কোনো আশাই শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। আমিতো মনে করি এইটি আশা ভঙ্গেরই বছর।’ বাশার এমন কথা কেন বলবেন না! যেখানে ১০ টেস্ট খেলার কথা সেখানে দল খেলেছে মাত্র ২টি। সব শঙ্কা উড়িয়ে পাকিস্তান সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। সিরিজের প্রথম টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে হারে মুমিনুল হক সৌরভের দল। এরপর অবশ্য জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নয়া অধিনায়ক ইনিংস ব্যবধানে জিতে ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দেন। কিন্তু সেখানেই থমকে যায় এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। পাকিস্তানে সিরিজের শেষ টেস্ট খেলতে আর যাওয়া হয়নি। শুধু কী তাই! বড় আক্ষেপ বোধহয় অস্ট্রেলিয়াকে ঘরের মাঠে না পাওয়া। স্টিভেন স্মিথদের বিপক্ষে কালেভদ্রে পাওয়া টেস্ট খেলার সুযোগ করোনার কারণে ভেস্তে যায়। এরপর শ্রীলঙ্কায় দুই দফায় স্থগিত হয় তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ। নিউজিল্যান্ড সফরও পিছিয়ে যায়। বলার অপেক্ষা রাখেনা টেস্ট চ্যাম্পিয়ান শিপের লাইয়ে বেশ টাইগারদের এখন তাকিয়ে থাকতে হবে নতুন বছরের দিকে। যদি পুরোনা সূচি আবার জীবন পায় সেই আশায়।

গেল বছরে বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলেছে মাত্র তিনটি। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর এত কম ওয়ানডের বছর আর দেখেনি দেশের ক্রিকেট। সবচেয়ে বেশি হাতছাড়া হয়েছে টি-টোয়েন্টি। দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সঙ্গে এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপ মিলিয়ে অনেক টোয়েন্টি খেলার কথা ছিল বছর জুড়ে। যার অনেকগুলো পুনর্বিন্যাস করা হলেও বেশ কয়েকটি আবার বাতিলের খাতায়। শুধু তাই নয়, দেশের নারী ক্রিকেটের সামনে খেলার সুযোগ থাকলেও করোনার কারণে তাদেরও রাখা হয়েছে একেবারে ঝুঁকির বাইরে। সারা বছরে তারা মাত্র ৪টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে তাও অস্ট্রেলিয়াতে বিশ্বকাপে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *