‘কভিড-১৯ রোগে মৃত্যু নয় এটি হত্যাকাণ্ড’

৬৫ বছরের গোপাল সিংয়ের আগে থেকেই শ্বাসকষ্ট ছিল। ২০১৩ সালে তার একবার হার্ট অ্যাটাকও হয়েছিল। ১৮ জুলাই সেই গোপাল সিংয়ের বুকে তীব্র ব্যথা শুরু হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত তার কভিড-১৯ পরীক্ষা করানো হয়। তাতে ফল পজিটিভ আসে।

গোপাল সিংয়ের পরিবার দ্রুত তাকে বিহারের কাটিহার জেলার সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানকার ডাক্তার গোপাল সিংকে ভর্তি না করে তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বিষয়টি গোপালের ছেলে বিশালকে রীতিমতো হতবাক করে দেয়। তিনি বারবার চিকিৎসকদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তার বাবা আগের বছরই ভয়ানক মাত্রার নিউমোনিয়ায় ভুগেছেন। কিন্তু ডাক্তাররা তাদের আগের পরামর্শেই অনড় থাকেন।

বাসায় নিয়ে গোপালের জন্য একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করা হয়। একই সঙ্গে বিশাল বিভিন্ন হাসপাতালে যোগাযোগ করতে থাকেন, যদি একটি বেড পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো বেডই খালি ছিল না। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় গোপাল সিংয়ের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে। এতক্ষণে বিশাল অন্য একটি সরকারি হাসপাতালে একটি বেড ম্যানেজ করতে সক্ষম হন। কিন্তু সেটি বাসা থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে যাওয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করলেন বিশাল।

হাসপাতালের কাছাকাছি পৌঁছতে না পৌঁছতেই অ্যাম্বুলেন্সে রাখা সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হয়ে যায়। বিশাল তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে ফোন করেন, যেন সেখানকার গেটে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তারা যখন পৌঁছলেন তখন হাসপাতালের গেটে কেউ ছিল না। এছাড়া হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কোনো আইসিইউ বেড খালি নেই। গোপালকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে নেয়ার পরামর্শ দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

আইসোলেশন ওয়ার্ড তিনতলায়। লিফটও কাজ করছে না। বাধ্য হয়েই বিশাল ও তার ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধা মা গোপালকে স্ট্রেচারে করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে নেন। এ সময় কোনো ডাক্তার ও নার্স গোপালকে দেখতে আসেননি বলে বিশাল জানান। আইসোলেশন ওয়ার্ডের বাইরে ১০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল। কিন্তু কোনোটিই পূর্ণ ছিল না। সকালবেলায় গোপালকে অন্য হাসপাতালে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিশাল। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যান গোপাল।

দুঃখ ভারাক্রান্ত বিশাল বলেন, ‘বাবাকে বাঁচানোর সব চেষ্টাই করলাম। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনার কাছে হার মানতে হয়েছে আমাদের। তিনি কভিড-১৯ রোগের কারণে মারা যাননি। তাকে খুন করা হয়েছে। তিনি আমাকে বারবার বলছিলেন, আমরা যেন তাকে বাঁচাই। তার সেই মিনতি ভরা চাহনি কোনোদিন ভুলতে পারব না।’

এটি কেবলই একটি ট্র্যাজিক গল্প নয়। এটি ভারতের অন্যতম জনবহুল ও দরিদ্র রাজ্য বিহারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রুগ্ণ দশার প্রতিচ্ছবি। কভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় রাজ্যটির প্রস্তুতিতে কী পরিমাণ ঘাটতি রয়েছে, তারই প্রমাণ মেলে গোপাল সিংয়ের এই করুণ কাহিনীতে।

বিহারে এখন পর্যন্ত ৩৩ হাজারের বেশি কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে, যার সিংহভাগই শনাক্ত হয়েছে চলতি মাসে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, সেখানে কভিড-১৯ রোগে প্রাণহানির সংখ্যা তুলনামূলক কম। এখন পর্যন্ত ২১৭ জন মারা গেছে সেখানে। তবে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের চরম পর্যায়ে বিহারে পরিস্থিতি ভয়াবহ দাঁড়াতে পারে। কারণ রাজ্যটি নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জরুরি স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তুলতে সময়মতো ব্যবস্থা নেয়নি।

বিহারে ৪০ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মীর পদ এখনো খালি রয়েছে। সেখানে করোনা শনাক্তের পরীক্ষাও হচ্ছে অনেক কম। রাজ্যটিতে প্রতি ১০ লাখে মাত্র সাড়ে তিন হাজার জনের করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। ভারতে এ অনুপাত অন্যতম সর্বনিম্ন। বিবিসি

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *