‘ওহ কী দারুণ কণ্ঠ!’

বাঙালি গায়ক বললে, আজও যার মুখচ্ছবি আমাদের মনে প্রথমেই ভেসে ওঠে, তিনি হাতা গোটানো সাদা বাংলা শার্ট, ব্যাকব্রাশ করা চুল ও মোটা ফ্রেমের চশমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কানে মৌহূর্তিক আবেদন আনে—‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’, ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো, দুটি দিকে গেছে বেঁকে’, ‘এই মেঘলা দিনে একলা, ঘরে থাকে না তো মন’, ‘অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে’, ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি’, ‘ও নদীরে একটি কথাই শুধাই শুধু তোমারে’, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়’, ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’ কিংবা ‘ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো’র সেই অনবদ্য কণ্ঠস্বর। গানের কথা ও সুরকে স্বীকার করেও এটি বলা চলে যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়কির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিঃসন্দেহে তার কণ্ঠমাধুর্য। যে কণ্ঠ সম্পর্কে লতা মঙ্গেশকরের উচ্ছ্বসিত উচ্চারণ—‘হেমন্তদার গান শুনলেই মনে হয় মন্দিরে বসে কোনো এক সাধু ভজন গাইছেন।’ আর এই মায়াভরা কিংবা নিখাদ কণ্ঠের আবেশেই দশকের পর দশক শ্রোতাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন তিনি। কেবল গায়ক; এই আপাত সরল পরিচয়ের বাইরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হয়ে উঠেছেন বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছিন্ন, অনিবার্য অংশ।

এটি অবিদিত নয় যে মান্না দের তুল্য সংগীতের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা গুরুমুখী বিদ্যা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছিল না। বরং তার গায়কিটা ছিল সহজাত। যার প্রধান দুটি অবলম্বন—তার কণ্ঠ ও সেই কণ্ঠে যেকোনো সুর তুলে নেয়ার তাত্ক্ষণিক প্রতিভা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীতচর্চার প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, তিনি নিজেকে কেবল আধুনিক বাংলা গানের পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। সেটি প্রাথমিক কাল হতেই। তার সংগীতজীবনের আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক: রবীন্দ্রসংগীত ও মুম্বাইয়ের হিন্দি গানের জগৎ। সব শিল্পীর জীবনেই এমন কিছু বিশিষ্ট সন্ধিক্ষণ থাকে, যে সন্ধিক্ষণ থেকে আরম্ভ হয় তার জীবনের এক নবতর অধ্যায়ের, পথচলার। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের শিল্পীজীবনও এই প্রবণতার ব্যতিক্রম ছিল না। তার জীবনে এই সন্ধিক্ষণটি এসেছিল কবি ও সুরকার সলিল চৌধুরীর হাত ধরে। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের অন্তিমপাদে তিনি সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে গেয়েছিলেন তার প্রথম বিখ্যাত ও সফল বাংলা গান ‘কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনায় শোনো রূপকথা নয় সে নয়’। তার পর থেকেই আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যে পরিণত সংগীতজীবন আমরা প্রত্যক্ষ করি, তার প্রধান দুটি দিক হলো—গায়ক ও সুরকার। এ দুটি ভূমিকায় আধুনিক গানের সমান্তরালে তাকে দেখা গেছে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের ভুবনেও। ১৯৫২ সালে হিন্দিতে মুক্তি পেয়েছিল ‘আনন্দমঠ’ চলচ্চিত্রটি। এখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতা মঙ্গেশকর গেয়েছিলেন বিখ্যাত সেই গান ‘বন্দে মাতরম’। এক্ষত্রে ১৯৫৪ সালের ‘নাগিন’ চলচ্চিত্রটির কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। যাতে হেমন্তের সুর করা লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া—মন ডোলে মেরা তান ডোলে মৈরা—কিংবা তার নিজের গাওয়া—তেরে দোর খাড়া ইক যোগী’ রীতিমতো কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর করা বলিউডের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘শার্ট’, ‘বিশ সাল বাদ’, ‘বিন বাদল বারসাত’, ‘অনুপমা’, ‘খামোশি’ ইত্যাদি। ‘খামোশি’-তে ভরাট কণ্ঠে তার গাওয়া ‘ইয়ে নয়ন দারে দারে’ আজও আমাদের স্বপ্নকাতর করে তোলে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজে যেমন গেয়েছেন, তেমনি তার সুরে গান করেছেন স্বর্ণযুগের হিন্দি গানের প্রায় অধিকাংশ শিল্পীই।

অবশ্য বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরো পুরনো। তিনি ১৯৪৪ সালে ‘নিমাই সন্ন্যাস’ চলচ্চিত্রে প্রথম কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন। এরপর কয়েকটি চলচ্চিত্রে সুরও দিয়েছিলেন। তবে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য পাননি। সুরকার হিসেবে তার সাফল্য এসেছিল ১৯৫৫ সালে উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘শাপএমাচন’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এ চলচ্চিত্রে তিনি কেবল সুরই দিলেন না, সঙ্গে গাইলেনও ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’, ‘শোনো বন্ধু শোনো, এই শহরের ইতিকথা’ ও ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো সুকতারা’র মতো জনপ্রিয় গানগুলো। ‘শাপমোচন’ই তাকে সুরকার হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রে একটি আলাদা ও স্থায়ী আসন তৈরি করে দিয়েছিল। এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই পথচলা আরম্ভ হয়েছিল হেমন্ত-উত্তম জুটির। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পরিণত হয়েছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমারের কণ্ঠে, ধ্বনিতে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি—‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’, ‘লুকোচুরি’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘সোনার হরিণ’, ‘অতল জলের আহ্বান’, ‘পলাতক’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘মণিহার’, ‘বালিকা বধূ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’র তুল্য চলচ্চিত্রগুলোতে গায়ক ও সুরকার হিসেবে তার পথচলা সাফল্যের সঙ্গে অব্যাহত থেকেছে। বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহারের ক্ষেত্রেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন। একেবারেই শেষ দিকে, তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’-তে তার গাওয়া ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে’, কিংবা ‘নিঠুর হে এই করেছো ভালো’ এখনো আমাদের এক পবিত্র ব্যথায় ভারাতুর করে তোলে।

আবার কেবল চলচ্চিত্রের সুরকার হিসেবেই নন; আধুনিক বাংলা গানের সুরেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন অনবদ্য। প্রবাদপ্রতিম লতা মঙ্গেশকরকে বাংলা গানের জগতে নিয়ে এসেছিলেন তিনিই। ১৯৫৮ সালে তারই সুরে লতা মঙ্গেশকর গেয়েছিলেন প্রথম আধুনিক বাংলা গান ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে/ আমারই এ দুয়ার প্রান্তে’। রবীন্দ্রসংগীতকে শান্তিনিকেতনের রক্ষণশীলতা থেকে মুক্ত করে যে কজন শিল্পী জনসাধারণের গান করে তুলেছিলেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে অন্যতম ও অগ্রগণ্য। এটি স্বীকার করতে মোটেই দ্বিধা নেই যে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদেরও একজন। অবশ্য এজন্য তাকে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে, পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। তবে রবীন্দ্রনাথের গানকে তিনি কখনো ত্যাগ করেননি; বরং আঁকড়ে রেখেছেন আজীবন।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গায়ক ও সুরকার; দুটো ভূমিকাতেই আমৃত্যু সংগীতের সাধনা করে গেছেন, গানকে রেখেছেন কণ্ঠে। আমরা যদি বলি, তিনি চলে গেছেন গান গাইতে গাইতে; বোধহয় খুব একটা অত্যুক্তি করা হবে না। শেষ বয়সেও তার অনেক লাইভ রেকর্ড আমরা দেখেছি, শুনেছি। এবং মুগ্ধ হয়ে তার কণ্ঠ সম্পর্কে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে মান্না দের করা সেই মন্তব্যের মতোই উচ্চারণ করেছি, ‘ওহ কী দারুণ কণ্ঠ!’। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আবু হেনা মোস্তফা কামালের উপস্থাপনায় তিনি যে অনবদ্য গেয়েছিলেন; সেদিনও কে জানত এই গান করার কদিন বাদেই তিনি চলে যাবেন! হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চলে গেছেন, তবে বাঙালিকে তিনি রিক্ত করে যাননি। ‘সোনার তরী’র সেই কৃষকের শস্যের তুল্যই, হেমন্তের গানকে, কণ্ঠকে ধরে রেখেছে মহাকাল। যাতে আমরা আজও নিমগ্ন হই; আমাদের আনন্দ ও বেদনা উদযাপন করি। জন্মশতবর্ষে তার প্রতি হার্দিক প্রণতি।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *