২০২০ সালটা ক্রীড়াঙ্গনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে ভিন্ন কারণে। পুরো বিশ্বের মতো অদৃশ্য করোনাভাইরাসের থাবা পড়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেও। তবে বছরের শেষ প্রান্তে এসে স্থবিরতা কাটিয়ে মাঠে ফেরে খেলা। ফেডারেশন কাপ দিয়ে শুরু হয় ঘরোয়া ফুটবল। স্থগিত হওয়া নারী ফুটবল লীগও মাঠে গড়িয়েছে। হকি, আরচারি, শুটিং, সাঁতারের বন্ধ তালাও খুলেছে। ছোট ছোট ফেডারেশনগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে খেলায় ফিরেছে।
করোনায় লণ্ডভণ্ড ফুটবল সূচি
ঠাসা সূচি নিয়ে শুরু হয় ২০২০ সাল। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের গ্রুপ পর্বের বাকি ম্যাচ, এএফসি কাপ, মুজিববর্ষের খেলা, বয়সভিত্তিকসহ সিনিয়র সাফ ফুটবল, টানটান উত্তেজনার প্রিমিয়ার লীগ ও সাত বছর পর মাঠে গড়ানো নারী লীগ সবকিছু ভেস্তে গেছে এই করোনায়।
অনিশ্চয়তার বেড়াজালে প্রায় আট মাস ঘরবন্দি সময় কাটাতে হয় ফুটবলারদের।
শুরুতেই বসুন্ধরা কিংসের শিরোপা: ফেডারেশন কাপ ২০১৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বর শুরু হয়ে ৫ই জানুয়ারি হয় ফাইনাল। রহমতগঞ্জ এমএফসি তাদের ইতিহাসে প্রথমবার ফাইনালে খেলে। পুরান ঢাকার দলকে ২-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে বসুন্ধরা কিংস।
বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপ: গত বছর যুবভারতীতে ভারতের সঙ্গে ১-১ ড্রয়ে স্বপ্ন বোনা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। ১৫ই জানুয়ারি শুরু হওয়া বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের ষষ্ঠ আসরে সেই স্বপ্নের কবর হয় সেমিতে। বুরুন্ডির কাছে ৩-০ গোলে হেরে আরেকবার শূন্য হাতেই ঘরের মাঠে বিদায় নিতে হয় জামাল ভূঁইয়াদের।
৩৬ ম্যাচে শেষ উত্তেজনাকর প্রিমিয়ার লীগ: ১৩ই ফেব্রুয়ারি মাঠে গড়ায় প্রিমিয়ার লীগের ১২তম আসর। ৬ রাউন্ডে হয়েছে মোট ৩৬টি ম্যাচ। এবারের লীগ গত কয়েক বছরের সবচেয়ে উত্তেজনাকর হতে যাচ্ছিল। যেখানে ফেভারিট বলে কেউ ছিল না। পয়েন্ট টেবিলও ছিল উত্তেজনার পরশে টালমাটাল। করোনায় লীগ স্থগিত হয়ে যায় ১৫ই মার্চ। শেষ পর্যন্ত লীগ বাতিল করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন।
করোনায় স্থগিত বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ক্যাম্প: মার্চ ও জুনে বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের বাকি ম্যাচগুলো হওয়ার কথা ছিল। সেগুলোও স্থগিত হয়ে যায় ৯ই মার্চ। পরে অক্টোবর-নভেম্বরে খসড়া সূচি রাখে ফিফা ও এএফসি। তারপরই করোনার বাস্তবতা দেখে ফেডারেশন। ম্যাচের জন্য ক্যাম্পের ডাক দেয়া হলে ২৪ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ১৮ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হলে হুলুস্থুল শুরু হয় দেশজুড়ে। ফুটবল ক্যাম্প পরিণত হয় আইসোলেশন সেন্টারে। শেষ পর্যন্ত বাস্তবতা রূপ নেয় ম্যাচ স্থগিতের মধ্য দিয়ে।
কিংসের আক্ষেপে শেষ এএফসি কাপ: এশিয়ান ক্লাব ফুটবলের অন্যতম বড় আসর এএফসি কাপের অভিষেকে স্বপ্নের মতো শুরু করে বসুন্ধরা কিংস। ১১ই মার্চ প্রথম ম্যাচে ঘরের মাঠে মালদ্বীপের টিসি স্পোর্টসকে ৫-১ গোলে উড়িয়ে দেয় অস্কার ব্রুজনের শিষ্যরা। লিওনেল মেসির সাবেক সতীর্থ হারনান বারকোস কিংসের জার্সিতে অভিষেকেই বাজিমাত করেন চার গোল করে। অক্টোবরে স্থগিত হওয়া আসর শুরুর নতুন সূচি ঘোষণা করে এএফসি। করোনার মধ্যেই সব বিদেশিকে ঢাকায় এনে প্রস্তুতিও শুরু করে বসুন্ধরা কিংস। পরে ১০ই সেপ্টেম্বর টুর্নামেন্টটি বাতিল করে দেয় এএফসি।
নেপালের বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের পর দোহায় পাঁচ গোলের হার: করোনায় আট মাস বন্দি থাকার পর নভেম্বরে নেপালকে আমন্ত্রণ করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নেপালের সঙ্গে প্রথম ম্যাচে জেতার পর দ্বিতীয় ম্যাচে ড্র নিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফেরে লাল-সবুজরা। এর মধ্যেই ফিফা-এএফসির বিশেষ অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায় কাতার। সেই অনুরোধ রাখতেই মাত্র এক মাসের প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্বকাপ বাছাই খেলতে দোহায় যায় বাংলাদেশ। প্রস্তুতির ঘাটতির বাস্তবতা দেখে বাংলাদেশ। ৫-০ ব্যবধানে হারের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফেরেন ফুটবলাররা।
নারী লীগে কিংসের শিরোপা: সাত বছর পর নারী লীগ মাঠে ফেরার পর স্থগিত হয়ে যায় মার্চে। পরে নভেম্বরে নারী লীগ দিয়েই ঘরোয়া ফুটবল শুরু হয়। সাত দলের লীগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় অভিষিক্ত দল বসুন্ধরা কিংস। এছাড়াও জেএফএ কাপ অনূর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল মাঠে গড়ায়। এসবের মধ্যে ১৮ই ডিসেম্বর ফিফা র্যাঙ্কিং থেকে হারিয়ে যায় বাংলাদেশের নারী দলের নাম। তিন মাস আগে সবশেষ সংস্করণে থাকলেও হালনাগাদের পর নিখোঁজ সাবিনা-কৃষ্ণারা। দীর্ঘ ১৮ মাস আন্তর্জাতিক ফুটবলে না থাকায় র্যাঙ্কিং থেকেই বের হয়ে যেতে হয় বাংলাদেশকে।
ফেডারেশন কাপ দিয়ে শুরু ঘরোয়া ফুটবল: বাতিল হওয়া ফুটবল মৌসুম মাঠে গড়িয়েছে ফেডারেশন কাপের মধ্যদিয়ে। আগামী ১৩ই জানুয়ারি লীগ শুরু হবে জানিয়েছে বাফুফে।
ভারতের আই লীগে জামাল ভূঁইয়া: ভারতের আই লীগে কলকাতা মোহামেডানের সঙ্গে চুক্তি করেন জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া। ছয় বছর পর প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিদেশের লীগে খেলতে যান তিনি। এর আগে ২০১৪ সালে সবশেষ ভারতের আইএসএলে অ্যাটলেটিকো ডি কলকাতার হয়ে খেলেন মামুনুল ইসলাম।
আলোচিত বাফুফে নির্বাচন: নানা ঘটনার জন্ম দেয়া বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় অক্টোবরের শেষদিনে। কাজী সালাউদ্দিনের বিপরীতে নির্বাচনে সভাপতি পদে দাঁড়ান বাদল রায় ও শফিকুল ইসলাম মানিক। নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে চতুর্থবার সভাপতি নির্বাচিত হন কাজী সালাউদ্দিন। তার প্যানেলও পায় নিরঙ্কুশ জয়।
বাদল রায়ের মৃত্যু: গত ২২শে নভেম্বর বিকাল সাড়ে ৫টায় না ফেরার দেশে চলে যান আশির দশকের মাঠ মাতানো ফুটবলার বাদল রায়। তিনি লিভার ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার ছিলেন বাদল। ক্লাব পর্যায়ে দুই দশকেরও বেশি সময় তিনি খেলেছেন ঢাকা মোহামেডানের হয়ে। ১৯৭৭ সালে দেশের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির বিখ্যাত সাদা-কালো জার্সিতে অভিষেক হয় তার। খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানার পর ফুটবল সংগঠক হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছিলেন বাদল। প্রিয় ক্লাব মোহামেডানের কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সহ-সভাপতি পদেও আসীন ছিলেন। বাদল রায় ছাড়াও করোনার কাছে আত্মসমর্পণ করে এ বছর অন্যলোকে পাড়ি দিয়েছেন বেশ কয়েকজন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। সেপ্টেম্বরে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য নওশেরুজ্জামান, জুনে জাতীয় দলের সাবেক মিডফিল্ডার নুরুল হক মানিক, নভেম্বরে ভলিবল কোচ গোলাম রসুলের মৃত্যু নাড়িয়ে গেছে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। মে মাসে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। একই মাসে কারাতে কোচ হুমায়ুন কবিরের চলে যাওয়াও ব্যথিত করেছে সবাইকে। সেপ্টেম্বরে সাবেক ক্রিকেটার এ এস এম ফারুক, জুনে রামচাঁদ গোয়ালার মৃত্যুও নামায় শোকের ছায়া। আগস্টে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সাবেক হকি খেলোয়াড় এহতেশাম সুলতানের মৃত্যই বা ভুলবে কী করে ক্রীড়াঙ্গন!
দুই টুর্নামেন্টে বছর শেষ হকির
করোনার মধ্যে অন্যান্য ফেডারেশনের কার্যক্রম চললেও ব্যতিক্রম ছিলো হকি। লীগের খবর নেই। নামকাওয়াস্তে দুটি সার্ভিসেস টুর্নামেন্ট দিয়ে বছর শেষ করেছে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম ফেডারেশনটি। মাঝে অবশ্য জুনিয়র এশিয়া কাপ হকির জন্য ক্যাম্প শুরু করেছিলো ফেডারেশন। কোভিড-১৯ টেস্টের মধ্যেদিয়ে ২৪ খেলোয়াড় নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন কোচ মামুনুর রশীদ।
অন্যান্য খেলাধুলা
আগস্টে সরকার খেলাধুলার অনুমতি দিলে ফিরে আসে স্বস্তি। ৩রা সেপ্টেম্বর আন্তঃজেলা তায়কোয়ান্দো দিয়ে খেলা ফেরে মাঠে। এরপর মাঠে গড়াতে থাকে অন্য খেলাও। করোনাকালের নিয়ম মেনে এখন প্রায় সব খেলার খেলোয়াড়েরাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তবু এ বছরটা মানুষের স্মৃতিতে থেকে যাবে মাঝের খেলাহীন দুঃসহ সময়টার জন্যই। মাঠে খেলা না থাকার কারণে টান পড়েছে খেলোয়াড়দের আয়ে। ছোট খেলার অনেক খেলোয়াড়ের পরিবারে জ্বলেনি চুলা।
তারকা খেলোয়াড়দের সময়ও কেটেছে ঘরেই। মালয়েশিয়ায় মার্চের শুরুতে খেলে আসা সিদ্দিকুর রহমান তো বলতে গেলে বসেই ছিলেন। দেশসেরা গলফারের জীবন থেকে ব্যস্ততা কেড়ে নিয়েছে ২০২০। তবে অনলাইন উপযোগী খেলাগুলোর খেলোয়াড়েরা এর মধ্যেও ব্যস্ত ছিলেন। দাদাবাড়ুরা অনলাইনে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেন। ভারোত্তোলন, তায়কোয়ান্দো, শুটিংও হয়েছে অনলাইনে।
অথচ খেলাধুলা ঘরে ঢুকে যাওয়া বছরটি হতে পারত মাঠে-ময়দানে জমজমাট। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে নানা ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক আয়োজন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। প্রায় সব ফেডারশেনই নিয়েছিল আন্তর্জাতিক আয়োজনের উদ্যোগ। টোকিও অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল আরচারি, শুটিং। এপ্রিলে বাংলাদেশ গেমস, জুনে এশিয়ান জুনিয়র হকি সবই পিছিয়ে চলে গেছে ২০২১ সালে।