বাংলাদেশী ওষুধ কোম্পানি এসকায়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে জিলিয়াড উদ্ধাবিত অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডিসিভির আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকার। অনেকটা আকস্মিকভাবে নেয়া মহারাষ্ট্রের রাজ্য সরকারের এ সিদ্ধান্ত ভারতের ওষুধ শিল্প খাত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে রীতিমতো হতচকিত করে দিয়েছে। খবর মানিকন্ট্রোল।
অন্যদিকে উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠান জিলিয়াড বলছে, বাংলাদেশে এসকায়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস বা অন্য কোনো ওষুধ কোম্পানিকে এখনো রেমডিসিভির উৎপাদনের লাইসেন্স দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। যদিও জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশসংক্রান্ত বাণিজ্য নীতি অনুযায়ী, বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো লাইসেন্স ছাড়াই বৈধভাবে ওষুধটি উৎপাদন করতে পারে। অন্যদিকে মহারাষ্ট্র সরকারের দিক থেকে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ভারতীয় বিশ্লেষক ও আইনি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, যদি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য এ ওষুধ আমদানি না করা হয়, তাহলে বিষয়টি সম্পূর্ণরূপেই আইনসিদ্ধ।
এর আগে গত ৬ জুন মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ টোপি জানান, প্রতি বোতল ১২ হাজার রুপি মূল্যে ঢাকাভিত্তিক এসকায়েফ ফার্মার কাছ থেকে ১০ হাজার ডোজ রেমডিসিভির সংগ্রহ করবে রাজ্যটি। এ বিষয়ে জিলিয়াডের পক্ষ থেকে বলা হয়, পণ্যটির বিশ্বাসযোগ্যতা বা কার্যকারিতা সম্পর্কে জিলিয়াডের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের মন্তব্য করা বা নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়। কারণ এটি জিলিয়াড বা আমাদের লাইসেন্স গ্রহণকারী অংশীদারদের উৎপাদনকৃত নয়।
মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকার এমন এক সময় এ ঘোষণা দিলো, যখন সিপলা, হেটেরো ও জুবিলিয়েন্ট লাইফ সায়েন্সেস নামে তিনটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান দেশটির ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে রেমডিসিভির বিপণনের অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ১২৭টি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে ওষুধটি উৎপাদন ও সরবরাহের জন্য এরই মধ্যে জিলিয়াডের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়েছে প্রতিষ্ঠান তিনটি।
ভারতে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সবচেয়ে বিপর্যস্ত রাজ্য মহারাষ্ট্র। রাজ্যটিতে সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বন্দরনগরী মুম্বাই। সংক্রমণের সংখ্যায় এরই মধ্যে উহানকে ছাড়িয়ে গিয়েছে শহরটি। কভিড-১৯-এর চিকিত্সায় ভারতে রেমডিসিভির ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হলেও তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার শুরু হয়নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এসকায়েফের কাছ থেকে রেমডিসিভির কেনার পরিকল্পনা করতে বাধ্য হয়েছে মহারাষ্ট্র সরকার।
এ বিষয়ে মেধাস্বত্ত্ব লংঘন নিয়ে মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের মাথা ঘামানোর খুব একটা প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন মুম্বাইভিত্তিক মেধাস্বত্ত্ব বিষয়ক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান গোপাকুমার নায়ার অ্যাসোসিয়েটসের স্বত্তাধিকারী ড. গোপাকুমার নায়ার বলেন, আমাদের এ নিয়ে মাথা ঘামানো উচিৎ হবে না। ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়াও (ডিসিজিআই) মেধাস্বত্ত্বের বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি অবগত রয়েছে। এবং এক্ষেত্রে রেমডিসিভির আমদানি করাটা শতভাগ আইনসম্মত।
ড. গোপাকুমার নায়ার বর্তমানে রেমডিসিভির উৎপাদনকারী আরেক বাংলাদেশী ওষুধ কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মার কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন।
জিলিয়াডের অনুমোদন না থাকলেও মূলত জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিধির সুবিধা নিয়ে রেমডিসিভির উৎপাদন করছে বাংলাদেশী দুই প্রতিষ্ঠান এসকায়েফ ও বেক্সিমকো ফার্মা। ওই বিধি অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট স্বত্ত্ব ছাড়াই জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রেখে প্রয়োজনীয় ওষুধ উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। উৎপাদনের পাশাপাশি অন্যান্য দেশে ওষুধটি রফতানিও করছে প্রতিষ্ঠানদুটি। ফলে ওষুধ কোম্পানিদুটিকে সরাসরি প্রতিযোগী হিসেবে দেখছে ভারতীয় ওষুধ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত রেমডিসিভির মানের দিক থেকে কোনো অংশেই কম নয়। এবং ইউএসএফডিএ নির্ধারিত মানগুলোর সঙ্গে তা পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বৃহদায়তন এক কনসাল্টিং ফার্মের একজন অংশীদার বলেন, ভারতীয় বেশ কিছু প্রযুক্তিগত ও আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশী কোম্পানিগুলোকে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশেরও বৈশ্বিক জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে পাওয়ার হাউজ হয়ে ওঠার উচ্ছাকাঙ্খা রয়েছে। এজন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতা বাংলাদেশের রয়েছে এবং এখানে ইউএসএফডিএ নির্ধারিত মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অনেক ফ্যাসিলিটি রয়েছে এখানে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এখানে অন্যত্র পেটেন্ট করা ওষুধ কপি করার সুযোগ রয়েছে। কভিড-১৯-এর কারণে বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এ দক্ষতাকে কাজে লাগানোর কার্যকর সুযোগ পেয়েছে।
জিলিয়াডের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণকারী ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের এক নির্বাহী জানান, ডিসিজিআইয়ে তার প্রতিষ্ঠানের রেমডিসিভির উৎপাদন ও বিপণনের অনুমতির আবেদনটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এজন্য ডিসিজিআই প্রতিষ্ঠানটির কাছে প্রাণীর ওপর ওষুধে প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত গবেষণার তথ্য-উপাত্ত চেয়ে পাঠিয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এ তথ্য জমা দেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছি। এসকায়েফের কাছ থেকে মহারাষ্ট্রের ওষুধ আমদানি প্রসঙ্গে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জিলিয়াড ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, লাইসেন্সকৃত ওষুধের ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণের স্বাধীনতা রয়েছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওষুধটির মূল্য কতো হবে, তা এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি জিলিয়াড।
কস্ট বেনেফিট মডেলিংয়ের ভিত্তিতে বোস্টনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দি ইনস্টিটিউট ফর ক্লিনিকাল অ্যান্ড ইকোনমিক রিভিউ (আইইসিআর) রেমডিসিভিরের পুরো কোর্সের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ হাজার ৪৬০ ডলার (৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা প্রায়)। অন্যদিকে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে প্রতি বোতল রেমডিসিভির বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার টাকায়। সেক্ষেত্রে পাঁচ দিনের চিকিত্সা কোর্সে রেমডিসিভির বাবদ মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৩৫ হাজার টাকায়, যা আইইসিআরের নির্ধারিত মূল্যের ১০ শতাংশেরও কম।