এতিমখানার শিশুরাও সংকটে

করোনাভাইরাসের সংকটের পর এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাকাল মানুষ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সংকটে এতিমখানার শিশুরাও। মানুষের দান এবং সদকায় চলে এমন এতিমখানাগুলোর শিশুদের জন্য সংকট তৈরি হয়েছে। প্রভাব পড়েছে দান-সদকা করা মানুষের ওপর। কমেছে সহায়তার পরিমাণ। প্রতি বছর রমজানে এ সকল শিশুদের মুখে হাসি ফুটলেও দু’বছর ধরে দেখা যাচ্ছে কষ্টের ছাপ। খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে দিন কাটছে অনাথ ও দুস্থ শিশুদের। এতিমখানার দায়িত্বরতদের পোহাতে হচ্ছে বেগ।

রাজধানীর কয়েকটি এতিমখানায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, রমজানে বন্ধ নেই এ সকল এতিমখানা। এই দুস্থ এতিম শিশুদের কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই। তবে কিছুসংখ্যক শিশু যাদের বাবা-মা ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন আছেন তারা ঈদে গ্রামে যাবে। রমজান মাস কাটবে এতিমখানায়। আর যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তারা সারা বছর এই এতিমখানায় দিনযাপন করেন। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে এ সকল শিশুরা। সংকট তৈরি হলে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন দিয়ে খাবার এবং পড়াশোনার খরচ চালায়। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ সকল শিশুদের মুখে খাবার জোটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
মিরপুরের ৬০ ফিটে অবস্থিত মাদ্রাসাতুল ইরফান আল ইসলামিয়ার মুফতি জামিল হোসাইন বলেন, এখানে এতিম শিশু আছে ৫ জন। সবাই এখানে থাকে। সবাইকেই আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। এখানে যারা আসে সবাই বাবা-মা ছেড়ে এসে আমাদের কাছে থাকে। এখন নিজেদের চেষ্টায় তাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মানুষের দান সদকার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো চলে। কিন্তু করোনার পর থেকে এসব এতিম শিশুদের চালাতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে। এরমধ্যে আবার নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছে। রমজানে তাদের সেহ্‌রি এবং ইফতার যোগাতে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে খুবই নাজুক পরিস্থিতি তারা বেতন, ভাতাও ঠিকমতো পাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের আবাসিকে আছে ২৮ জন এবং অনাবাসিকে সবমিলিয়ে ৫২ জন ছাত্র আছে। বাজার করতে গেলে খানিকটা বোঝা যায় কষ্ট। পরিবারের খাবার বাঁচিয়েও তাদের জন্য মাঝে মাঝে খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। কয়েকজন মিলেই এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করি। ঈদের ছুটিতে কেউ যায় পরিবারের কাছে আবার কেউ মাদ্রাসায় থেকে যায়।
হাজারীবাগের আশরাফুল আল মাওলা এতিমখানা ও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হাফেজ মো. আব্দুল বারী বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটিতে ৮৫ জন এতিম শিশু আছে। এদের অনেকের বাবা-মা নেই। কারও শুধু মা আছে। আত্মীয়স্বজনরা এ সকল শিশুদের রেখে গিয়েছে। এদের খাবারে ব্যবস্থা সমাজের বিত্তমান মানুষের দ্বারাই হয়। অনেকে অনেকভাবে সহযোগিতা করে। কিন্তু বর্তমানে একটু সংকটে আছি। এতিমখানার পাশে একটি দোকান আছে। সেখান থেকে বাকিতে চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজীয় জিনিসপত্র নেয়া হয়। দান-সদকার টাকা যখন জমা হয় তখন তাদের পাওনা টাকা পরিশোধ করা হয়। বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় সময়টা অনেক খারাপ যাচ্ছে। তাদের আগের মতো খাবার দিতে পারছি না। এখান থেকে অনেকে হাফেজ হয়ে বেরিয়েছে। এই বছর রমজান মাস হলেও সেইভাবে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। এদের তো আর না খাইয়ে রাখা যায় না। তবে প্রতিদিন তাদের খাবার দেয়া হয় কিন্তু খুব বেশি ভালো খাবার দেয়া হয় না। কেউ কেউ তাদের খালা-মামাদের বাসায় গিয়ে ঘুরে আসে। আবার যাদের একদম কেউ নেই তারা সবসময় এখানেই থাকে।
এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র তরিকুল ইসলাম। তার মা আছে বাবা নেই। ময়মনসিংহ থেকে মা তাকে এতিমখানায় পড়াশোনার জন্য রেখে গিয়েছেন। তরিকুল বলেন, মা গ্রামে থাকে। বাবা অনেক আগে মারা গেছে। এখানে খাবার-দাবার মোটামুটি চলছে। রাতে আলু ভাজি আর ডাল দিয়ে খেয়েছি। আগের চেয়ে ভালো খাবার একটু কম খাওয়া হচ্ছে। দিনে একবার ভালো খাবার দেয়।
রহমাতুল্লাহ বলেন, এখন খাবার মোটামুটি খাই। আগে এর চেয়ে ভালো খাবার দিতো। আমার বাবা-মা কেউ নেই। ছোটবেলা থেকেই খালাকে চিনি। খালা আমাকে এই এতিমখানায় রেখে গেছেন। মোহাম্মদ আলী বলেন, তিনি রংপুর থেকে এসেছেন। পরিবারে শুধু মা আছে। বাবা নেই। হেফজখানায় পড়াশোনা করছি। আমার মা এখানে পাঠিয়েছে। আগের চেয়ে একটু কম খাবার খেতে হচ্ছে। তবুও কষ্ট হয় না।
ধানমণ্ডি ঝিগাতলার তাহফীজুল কুরআন হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, অন্যান্য রমজানের তুলনায় এইবার খুবই খারাপ অবস্থা যাচ্ছে। খুব কম সংখ্যক মানুষ দানের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে আমরা নিজেরা তাদের ভালো রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। গত দুই বছরে করোনার প্রভাবে অনেকটা খারাপ অবস্থা। এইবার রমজানে এসে সবকিছুর দাম বাড়তি। সবমিলিয়ে হতাশায় যাচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজেদের বেতন থেকে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
যাত্রাবাড়ী মারকাজুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানার পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, মাদ্রাসায় যারা সচ্ছল ছাত্র আছে তাদের বেতন দিয়ে এই এতিম শিশুদের চালানো হয়। এতিমখানায় মোট ২৬-২৭ জন ছাত্র আছে। এরমধ্যে ১২-১৩ জন এতিম। অন্য সবাই দুস্থ, অসহায়। বাকিদের মা-বাবা না থাকলেও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন আছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় শিশুদের চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর রমজান মাসে মানুষ খোঁজখবর কম নিচ্ছেন। আমরা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতা নিচ্ছি। কিন্তু খুব ভালো খাবার তাদের দিতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, খাবারের ব্যবস্থা করতে আমাদের বেশি কষ্ট হচ্ছে। করোনার কারণে প্রতিষ্ঠানের ভাড়া মিলিয়ে অনেক টাকার দেনা হয়ে আছি। তবে এই এতিম শিশুদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে আমরা নিজেদের সন্তানদের মতো দেখাশোনা করছি। বাজারে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদেরও সীমাহীন কষ্ট হচ্ছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *