ইউরোপে এস্ট্রাজেনেকা টিকা ব্যবহার স্থগিতের নেপথ্যে

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউরোপিয়ান মেডিসিন্স এজেন্সি (ইএমএ) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জনগণকে অক্সফোর্ড/এস্ট্রাজেনেকার টিকা নেয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফ্রান্স এবং জার্মানি। তারা অক্সফোর্ডের টিকার ব্যবহার স্থগিত করেছে। বিষয়টি ইউরোপিয়ান সরকারগুলোর মধ্যে এক অভিন্ন রীতি হয়ে উঠেছে। তারা অসীম সতর্কতা হিসেবে এমন ব্যবস্থা নিচ্ছে। বিশ্বের অন্য স্থানে মারাত্মক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জানা না গেলেও, ইউরোপিয়ান ওই দেশগুলো টিকার ব্যবহার স্থগিত করেছে। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল বলেছেন, এস্ট্রাজেনেকার টিকা নিরাপদ ও কার্যকর। তবে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর টিকা স্থগিত করাকে বৃটেনের কোন কোন মহল ব্রেক্সিটের প্রতিশোধ নেয়া হিসেবে দেখছেন।
এসব খবর দিয়েছে অনলাইন ডেইলি মেইল এবং দ্য গার্ডিয়ান।

টিকা দেয়ারা পর সম্প্রতি হাতেগোণা কয়েকজন মানুষের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধা ও অন্যান্য রিবল উপসর্গ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে থ্রোম্বোসাইটোপেনিয়া। এই অবস্থায় আক্রান্ত কোনো মানুষ পর্যাপ্ত পরিমাণে প্লেটলেটস তৈরি করতে পারে না। ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। এরই মধ্যে অস্ট্রিয়া এবং ইতালিতে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তারা টিকার একটি ব্যাচ সংক্রমিত হয়েছে এমন আশঙ্কায় ওই ব্যাচটির ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। এরই মধ্যে আবার নরওয়েতে থ্রোম্বোসাইটোপেনিয়াতে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পাশাপাশি তিনজন ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

গার্ডিয়ান লিখেছে, সরকারগুলো যখন এমন অবস্থায় অবতীর্ণ, তখন বেশির ভাগ বিজ্ঞানীর চোখ ছানাবড়া। ইএমএ এবং ডব্লিউএইচও ওইসব ঘটনার তদন্ত করছে। তবে এখন পর্যন্ত করোনার টিকা নেয়ার কারণে এসব ঘটনা ঘটেছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা নেয়ার পর যাদের রক্ত জমাট বেঁধেছে বা থ্রোম্বোসাইটোপেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন মোট জনসংখ্যার তুলনায় তাদের সংখ্যা নগন্য। যারা টিকা নেননি তাদের তুলনায় এ সংখ্যা খুব বেশি নয়। বিশ্বজুড়ে মেডিকেল বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অন থ্রোম্বোসিস অ্যান্ড হেমোস্টাসিস শুক্রবার বলেছে, বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষকে কোভিড-১৯ এর টিকা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে থ্রোম্বোটিকে আক্রান্তের সংখ্যা অনুল্লেখ্য। এর ফলে এটাই বোঝা যায় যে, টিকার সঙ্গে এর কোনো সরাসরি যোগসূত্র নেই। তারা আরো বলেছে, রক্ত জমাট বাঁধা একটি সাধারণ বিষয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত যারা টিকা নিয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি কমন নয়। তারা এক্ষেত্রে একটি সুপারিশ করেছে। বলেছে, যেসব মানুষের রক্ত জমাট বাঁধার বা যারা রক্ত ঘন করার ওষুধ ব্যবহার করছেন তাদেরও উচিত এই টিকা নেয়া।

বৃটিশ সরকারকে মেডিসিন্স অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি অথরিটি (এমএইচআরএ) এবং দ্য জয়েন্ট কমিটি অন ভ্যাক্সিনেশন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জেসিভিআই) পরামর্শ দিয়ে থাকে। তারা বলেছে, বৃটেন এরই মধ্যে অক্সফোর্ড/এস্ট্রোজেনেকা উৎপাদিত এক কোটি ১০ লাখ ডোজ টিকা প্রয়োগ করেছে। এক্ষেত্রে কোনো রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায়নি বলে জানিয়েছেন জেসিভিআইয়ের উপচেয়ারম্যান প্রফেসর অ্যান্থনি হার্ডেন। এমএইচআরএ বলেছে, তারা উত্থাপিত অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে এবং রিভিউ করছে। তবে এখন পর্যন্ত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে এস্ট্রাজেনেকাই বলেছে, ৮ই মার্চ পর্যন্ত পুরো ইউরোপ এবং বৃটেনে ১৫টি গভীর ধমনীতে থ্রোম্বোসিস (ডিভিটি) এবং ২২টি পালমোনারি এমবোলিজম (ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধা) শনাক্ত করা হয়েছে। সাধারণভাবে যে সংখ্যক মানুষের এসব দেখা দেয়, এ সংখ্যা তার চেয়ে অনেক কম। কিন্তু তাদের এমন কথা দৃশ্যত ইউরোপিয়ান সরকারগুলোর মাঝে জমাট বরফকে গলাতে পারছে না। এক্ষেত্রে অন্য ফ্যাক্টর কাজ করে থাকতে পারে।

একটি বিষয় হলো, হাজার হাজার মানুষের ওপর টিকা পরীক্ষায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবে না এমনটা কেউ বলতে পারেন না। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু মহামারির সময়ও এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। পরে দেখা গিয়েছিল যে, প্যানডেমরিক্স নামের একটি টিকার ৫৫ হাজারের মধ্যে একটিতে বাচ্চাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। বৃটেনে প্রায় ১০০ মানুষ এমন দুর্ভোগে পড়েছিলেন। এর ফলে দিনের বেলা কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই হঠাৎ করে তারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন। এ কারণে সাধারণভাবে রক্ত জমাট বাঁধার মতো করে এ বিষয়টি দেখলে হবে না। এক্ষেত্রে যেকোন রকম অভিযোগ সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করতে হবে। ডেনমার্কে মারা গেছেন ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। বলা হয়েছে, তিনি উচ্চ মাত্রায় অস্বাভাবিক লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন। নরওয়ে বলেছে, অস্বাভাবিক লক্ষণযুক্ত তিনজনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

প্রমাণের বাইরে অন্য বিষয়গুলো দেখতে হবে সরকারগুলোকে। তাদের এমন অবস্থানের ফলে টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেবে। এরই মধ্যে ফ্রান্সে টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে এক রকম লড়াই করতে হচ্ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর দিকে সাধারণ মানুষের সন্দেহের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সেই সন্দেহ সোয়াইন ফ্লু টিকার ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছিল। ফ্রান্স লাখ লাখ ডোজ টিকা কিনেছে। কিন্তু জনগণ তা নিয়ে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। হাম, মাম্ব এবং রুবেলা আছে এমন শিশুদের ক্ষেত্রে টিকা দেয়ার হার খুবই কম।
প্রবীণদের ওপর এস্ট্রাজেনেকার টিকা কেমনভাবে কাজ করবে, তার ব্যাখ্যা নেই। এ কারণে অধিক মাত্রায় সতর্কতা সামনে চলে আসে জার্মানিতে। এস্ট্রাজেনেকার টিকা ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে প্রথম অস্বীকৃতি জানায় জার্মানি।

এক্ষেত্রে আরো একটি ফ্যাক্টর কাজ করে থাকতে পারে। তা হলো, সরবরাহ স্থগিতের সিদ্ধান্ত। বৃটেনে পর্যাপ্ত পরিমাণে এই টিকার মজুদ আছে। কিন্তু ইউরোপে নেই। ইউরোপে দেয়া সরবারাহ আবারও কর্তনের কথা জানিয়েছে এস্ট্রাজেনেকা। বছরের প্রথম চতুর্ভাগে তারা সরবরাহ কমিয়ে ৩ কোটি ডোজের কথা বলেছে। প্রথমে যে পরিমাণ টিকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এস্ট্রাজেনেকা, এই সংখ্যা তার প্রায় এক তৃতীয়াংশ। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকা পাওয়া না যায়, তাহলে ইউরোপে তো টিকাদান কর্মসূচি স্থগিত করাই সহজতর!

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *