বিশ্ব অর্থনীতি এখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত। কঠিন এ সময়ে জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ ধরা হয়েছে। এ সময়ে এমন উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ঘোষিত বাজেট আশাব্যঞ্জক। তবে বাস্তবায়নে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট প্রতিক্রিয়ায় গতকাল এমনটিই জানিয়েছে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)। প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করে সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদ এ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা ও শত প্রতিকূলতা রয়েছে। এর মধ্যেও জনগণের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য কল্যাণমুখী বাজেট দেয়া হয়েছে বলে মনে করে বিসিআই।
প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো করদাতা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ১০ শতাংশ তৃতীয় লিঙ্গের শ্রমিক অথবা ১০০ অধিক কর্মচারী নিয়োগ সাপেক্ষে ৫ শতাংশ কর রেয়াতের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া দেশীয় পণ্য উৎপাদনকারী বৃৃহৎ শিল্পে (অটোমোবাইল খাত) ২০ বছর, হোম অ্যাপ্লায়েন্স শিল্পে ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে ১০ বছর কর অব্যাহতি এবং হালকা প্রকৌশল খাতে যন্ত্রাংশ উৎপাদনে ১০ বছর কর অব্যাহতি দেয়ায় অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিসিআই। এজন্য জাতীয় শিল্প চেম্বারটি বলছে, প্রস্তাবিত বাজেট দেশীয় শিল্প ও বেসরকারি খাত সহায়ক বাজেট।
বিসিআইয়ের পক্ষ থেকে কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। এ অবস্থায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মূলধনি যন্ত্রাংশের ওপর আরোপিত ১ শতাংশের অতিরিক্ত সব ধরনের শুল্ক-করাদি মওকুফ করার জন্য পুনরায় অনুরোধ জানিয়েছে শিল্প সংগঠনটি।
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিসিআই। দেশের সব মানুষের সুলভে মানসম্পন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম জেলার বাইরে স্থাপিত হাসপাতালে ১০ বছর কর অব্যাহতি দেয়ারও প্রশংসা করেছে তারা।
প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানোকে স্বাগত জানিয়েছে বিসিআই। তবে কমানোর এ ধারাবাহিকতা ন্যূনতম আগামী তিন বাজেটে অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছে তারা। এছাড়া বাজেটে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের আগাম কর (এটি) ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। এ আগাম কর সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করার প্রস্তাব তাদের।
৩ কোটি টাকার টার্নওভারে ন্যূনতম করহার দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করাকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিসিআই। তবে সংগঠনটি টার্নওভারের ন্যূনতম হার ৪ কোটিতে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় আগামী কর বছরের করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বিসিআই মনে করে, করারোপ হলে দেশে উচ্চশিক্ষার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয়ে তাদের মত, যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠান অলাভজনক। সে কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর প্রস্তাবিত করহার পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব করেছে তারা।
কভিড-১৯ জনিত কারণে কর্মহীনতা ও আয় হ্রাস কমাতে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচি প্রভৃতির আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা ইতিবাচক। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বিনিয়োগ, শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান প্রক্রিয়াকে গতিশীল করবে বলে বিসিআই মনে করে।
বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বিসিআই বলছে, দক্ষতা উন্নয়নে নজর দেয়া হয়েছে। মানবসম্পদকে সার্বিকভাবে উন্নয়ন করা হলে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এজন্য দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে নীতিমালা সহজীকরণ করে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রস্তাব দিয়েছে তারা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত বাজেটে বিশাল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হবে জানিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছে সংগঠনটি। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে কর অফিস স্থাপনের প্রস্তাব করেছে তারা। ফলে করের আওতা ও রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব বলে মত তাদের। ঘাটতি বাজেট পূরণে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। যার মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের কথা বলেছে। তবে বিসিআই মনে করে, সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে এ পরিমাণ ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সার্বিক বিষয়ে বিসিআইয়ের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে, দেশের জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য বাজেটের এ আকার অবাস্তব নয়। দেশের অর্থনীতির পরিকাঠামো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাজেটের আকারও প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুশাসন, যথাযথ মনিটরিং, বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি।