আফগান নির্মাতাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

‘তালেবানরা আমাদের মেরে ফেলবে। কাউকে জীবিত রাখবে না!’ মেসেঞ্জারে জানালেন এক আফগানি নির্মাতা বন্ধু। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেমন আছ? উত্তরে তার মৃত্যুর আশঙ্কা আমাকে অস্থির করে তোলে।

‘এখন তোমার কী সিদ্ধান্ত?’

উত্তরে সে জানায়, ‘দেশত্যাগের উপায় খুঁজছি। তালেবান আর শিল্পচর্চা দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। তারা কখনই আমাদের বেঁচে থাকতে দেবে না। আমি এ মুহূর্তে আত্মগোপনে আছি। আমার অন্য বন্ধুদের তারা গৃহবন্দি ও কড়া নজরদারির মধ্যে রেখেছে। তাদের কেউ সাংবাদিক, কেউ ফিল্ম অ্যাক্টিভিস্ট, কেউ লেখক, কেউ সংস্কৃতিকর্মী।’

আফগানিস্তানের এ নির্মাতা বয়সে তরুণ। তার নির্মিত তিনটি চলচ্চিত্র বিশ্বের বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ উৎসবে পুরস্কার জিতেছে। এছাড়া তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র উৎসবেরও অন্যতম সংগঠক। এ নির্মাতা ও সংগঠক বন্ধুর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সখ্য। চলচ্চিত্র নির্মাণ, চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন, বিশ্বব্যাপী তরুণ নির্মাতাদের নির্মাণশৈলীর নানা বিষয়ে তার সঙ্গে আলাপ হয়। কিন্তু গত কয়েক দিনের আলাপ গা শিউরে ওঠার মতো।

তার কাছেই জানতে পারলাম আফগানিস্তানের নির্মাতা সিদ্দিক বারমাক, আতিক রাহিমি, আজিজা দিলদার ও রয়া সাদাতদের খবর। তারা প্রত্যেকেই গত দুই দশকে আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পের সাহসী যোদ্ধা। এখন তালেবান যোদ্ধাদের হাতে তাদের জীবন সংকটময়। কেউ আছেন আত্মগোপনে। কেউ আছেন গৃহবন্দি। জীবন বাঁচাতে তারা দেশ ছাড়ার উপায় খুঁজছেন। সেকেন্ডে ২৪ ফ্রেমে যারা জীবনকে ধারণ করেন, তারাই এখন জীবনের হিসাব কষছেন প্রতি সেকেন্ডে, মুহূর্তে। যেন একটি নিঃশ্বাসের পর, আরেকটি মুহূর্তের পরই নেমে আসতে পারে ভয়ানক জীবননাশী নির্যাতন।

ধরা যাক, তালেবান সরকার তাদের হত্যা করল না। তাদের মানবাধিকার সংরক্ষিত থাকল। এমনটি ঘটলে তো শিল্পী-নির্মাতারা মুক্তি পাবেন। আমার এ ভাবনাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিলেন কাবুলের ডাকসাইটে এক অভিনেত্রী। তিনি বললেন, ‘তারা আমাদের বাঁচিয়ে রাখলেও আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে গলা টিপে হত্যা করবে। গত ২০ বছরে ইন্ডাস্ট্রি বড় হয়েছে। পেশাগতভাবে এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছে হাজার হাজার মানুষ। তারা বেকার হয়ে পড়বে। তখন তাদের মারতে তালেবানের বন্দুকের প্রয়োজন পড়বে না, ক্ষুধাই যথেষ্ট।’

ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হলে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হবে সংশ্লিষ্টদের? এর সঠিক খতিয়ান কেউ দিতে পারেননি। তবে শুধুই কাবুল শহরে বন্ধ হয়ে যাবে সাতটি সচল সিনেমা হল। এতদিন আফগানিস্তান ছাড়াও অন্যান্য দেশের সিনেমা এ হলগুলোয় প্রদর্শিত হয়ে আসছে। বেকার হয়ে পড়বেন হল ব্যবসায়ী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অনেকে। এর ঢেউ গিয়ে লাগবে ভারতীয় সিনেমায়ও। কারণ আফগানিস্তানে বলিউডের সিনেমার বাজার ছিল তুঙ্গে। বলিউডের কিছু প্রযোজক নিয়মিত আফগানিস্তানের নানা অঞ্চলে তাদের সিনেমার শুটিং করতেন। আশঙ্কা হচ্ছে, আফগান চলচ্চিত্র ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে বলিউড প্রযোজকদেরও গুনতে হবে আর্থিক লোকসান।

সিনেমা ছাড়াও আফগানিস্তানের বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে অনেক। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বহুজাতিক কোম্পানির বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছে এতদিন। সিনেমার সঙ্গে এগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে বিপুল আর্থিক ক্ষতি হবে ভিজ্যুয়াল ইন্ডাস্ট্রির।

আফগানিস্তানের প্রতিশ্রুতিশীল অভিনেত্রী ফাতিমা সাদি। তিনিও আতঙ্ক ও উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তার ধারণা, তালেবান নারীদের অধিকার কেড়ে নেবে। সেই সঙ্গে মুক্তমনা ও সৃজনশীল পেশার সঙ্গে যুক্ত নারীদের অপমানজনক শাস্তি দেবে।

কথা হলো আরেকজন নারী সাংবাদিকের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমরা দেশত্যাগ করতে চাই না। আমরা চাই তালেবান সরকার আমাদের স্বাধীন শিল্পচর্চার সুযোগ দিক। আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করুক। তাহলে আমরা প্রিয় মাতৃভূমিতেই শান্তিতে বসবাস করতে পারব। যদিও এটি দুরাশা মাত্র।’

এখন আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক অঙ্গনজুড়ে ভয়াবহ আতঙ্ক বিরাজ করছে। চুপসে গেছে কাবুলের চলচ্চিত্রপাড়া। চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই এখন আত্মগোপনে। অস্থিরতা বিরাজ করছে সব কলাকুশলীর মনে।

কাবুলের একজন লেখক ও নির্মাতা বললেন, ‘তোমরা কথা বলো। আমাদের নিরাপত্তার জন্য আওয়াজ তোলো।’ আমি বিষণ্ন মনে ভাবি, আমাদের প্রতিবাদে কার কী আসে যায়? তবুও মনে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শরতের প্রাক্কালে মনের গহীনে জমাট বাঁধে থোকা থোকা কালো মেঘ।

আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র নিয়ে আসলেই কি আমাদের ভাবার কিছু আছে? ২০০১ সালে তালেবান সরকারের পতনের পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা চলচ্চিত্র বিশ্বে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে সক্ষম হয়। গত দুই দশকের আফগান চলচ্চিত্রের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, তাদের অর্জন নিতান্তই কম নয়। সাম্প্রতিক সময়েও বিশ্বব্যাপী নানা চলচ্চিত্র উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদের্ঘ্য বিভাগে আফগানিস্তানের চলচ্চিত্রের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়।

২০০১ সালে মুক্তি পায় বিশ্ববিখ্যাত ইরানি নির্মাতা মোহসেন মাখমলবাফ নির্মিত নন্দিত চলচ্চিত্র কান্দাহার। সে বছরই কান চলচ্চিত্র উৎসবে মনোনয়ন পায় চলচ্চিত্রটি। টাইমস ম্যাগাজিনের ১০০ বছরের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায়ও স্থান করে নেয় ছবিটি। ছবির প্রেক্ষাপট ও শুটিং স্পট আফগানিস্তান হওয়ার কারণে এ ছবির মাধ্যমেই চলচ্চিত্র দুনিয়ার মানুষ আফগানিস্তানকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করে। এরপর ২০০৩ সালেই আফগান নির্মাতা সিদ্দিক বারমাক নির্মাণ করেন ওসামা। এটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন পাম অর্জন করে। ২০১২ সালে আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র বুজকাশি বয়েজ ৮৫তম অস্কার আসরে মনোনীত হয়।

একটি সফল চলচ্চিত্র এককভাবে নির্দিষ্ট কোনো দেশ, জাতি, ভাষার সম্পদ নয়। চলচ্চিত্রের ভাষা আন্তর্জাতিক। বিশ্বের যেকোনো ভাষা বা সংস্কৃতির শিল্প মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র মূলত গোটা চলচ্চিত্র বিশ্বেরই সম্পদ। সুতরাং আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বাঁচাতে আমাদের সবার জোর আওয়াজ তোলা উচিত।

দীপান্ত রায়হান: লেখক ও ফিল্ম অ্যাক্টিভিস্ট

ব্যবহূত ছবির ফটোগ্রাফার ভারতীয় ফটোসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকী। তিনি ১৫ জুলাই কান্দাহারে আফগান বাহিনী ও তালেবানদের সংঘর্ষের ছবি তোলার সময় নিহত হন। ২০১৮ সালে ফিচার ফটোগ্রাফিতে পুলিত্জার পুরস্কার পেয়েছিলেন।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *