আওয়ামী লীগের ৭১ ও কালের সাক্ষী সেই রোজ গার্ডেন

পুরান ঢাকার হৃষিকেশ দাস রোডের পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ছোঁয়া। ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যশৈলীর ছাপ আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রায় দুশো বছরের শাসন-শোষণের ইতিহাস। ৭৪ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনের ইতি ঘটলেও রয়ে গেছে তাদের আমলে গড়া স্থাপনাগুলো। পুরান ঢাকার হৃষিকেশ রোডে তেমনি একটি ভবনের নাম রোজ গার্ডেন। এ রোজ গার্ডেন থেকেই প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ঐহিত্যবাহী দল আওয়ামী লীগের।

পাকিস্তানী শাসন-শোষণ আর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা নিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এই রোজ গার্ডেনেই গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। এসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কারাবন্দি ছিলেন। আজ ২৩ জুন, আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অর্থাৎ ৭২ বছরে পা দিচ্ছে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী এ রাজনৈতিক দলটি। ৭ দশকেরও বেশির সময় আগে ফিরে তাকানোর সেই দিনেই ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে আওয়ামী ধারার রাজনীতির উত্থান ঘটেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে। 

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেম এর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয় এবং নাম রাখা হয় “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ”। 

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ূন সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।’

পথচলার প্রায় দুই যুগ পর (১৯৭১ সালে) এ দলটির নেতৃত্বে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে এসে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনকে নিজেদের ইতিহাসের দলিল হিসেবে ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ দুই হাজার ৯০০ টাকা ব্যয়ে কিনে নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। 

এ নিয়ে বছর দুই আগে একবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব:) ফারুক খান ব্রেকিংনিউজকে বলেছিলেন, ‘যতটুকু শুনেছি সরকার এটাকে ক্রয় করে জাদুঘরে রুপান্তর করার পরিকল্পনা রয়েছে। এটা একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। ১৯৪৯ সালে আলোচনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিলো এ ভবনে। সেই হিসেবে আমাদের কাছে এই ভবনের ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে, বাংলার জনগণের কাছেও রয়েছে। এ ধরনের স্থাপনায় জাদুঘর করা হলে দেশের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য খুবই ভালো হবে। এটা দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের অংশ।’

আওয়ামী লীগের বাহিরে অন্য কোনও সরকার ক্ষমতায় আসলে এই ভবনটির ওপর কোনও প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের সম্পদ কোনও সরকারই ধ্বংস করবে বলে আমি মনে করি না। তবে তারা যেটা চাইবে সেটা করবে। এ ভবনটা তো আওয়ামী লীগ করেনি। এটা ব্রিটিশ আমলে করা। এই ভবনের নিজস্ব একটা সৌর্ন্দয রয়েছে। এই সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। বিদেশেও আমি এরকম স্থান দেখেছি। আমেরিকাতে দেখেছি জর্জ ওয়াশিংটনের বাড়িটি তারা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করে রেখেছে।’ 

ঋষিকেশ দাস ছিলেন ব্রিটিশ আমলের নব্য ধনী ব্যবসায়ী। তবে সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসায় ঢাকার খানদানি পরিবারগুলো তেমন পাত্তা দিত না ঋষিকেশ দাসকে। কথিত আছে যে, একবার তিনি জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর বাগানবাড়ি বলধা গার্ডেনের এক জলসায় গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপরই তিনি রোজ গার্ডেন প্যালেস তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৩১ সালে পুরান ঢাকার ঋষিকেশ দাস রোডে একটি বাগানবাড়ি তৈরী করা হয়। বাগনে প্রচুর গোলাপ গাছ থাকায় এর নাম হয় রোজ গার্ডেন। ভবনটি সজ্জিত করণের কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই ব্যবসায়ী ঋষিকেশ দাস আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যান। ১৯৩৭ সালে তিনি রোজ গার্ডেন প্যালেসটি খান বাহাদুর আবদুর রশীদের কাছে বিক্রয় করে দিতে বাধ্য হন। 

প্রসাদটির নতুন নামকরণ হয় ‘রশীদ মঞ্জিল। মৌলভী কাজী আবদুর রশীদের কাছ থেকে ১৯৬৬ সালে রোজ গার্ডেনের মালিকানা পান তার বড় ভাই কাজী হুমায়ুন বশীর। এ কারণে সে সময় ভবনটি “হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি” হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে ১৯৭০-এ বেঙ্গল স্টুডিও ও মোশন পিকচার্স লিমিটেড রোজ গার্ডেন প্যালেসের ইজারা নেয়। হারানো দিন নামের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের শুটিং এই বাড়িতে হয়েছিল। 

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ১৯৮৯ সালে রোজ গার্ডেনকে সংরক্ষিত ভবন হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু আদালতে মামলা করে ১৯৯৩ সালে মালিকানা স্বত্ব ফিরে পান কাজী আবদুর রশীদের মেজ ছেলে কাজী আবদুর রকীব। ১৯৯৫ সালে তার প্রয়াণ হয়। এরপর থেকে অদ্যাবধি তার স্ত্রী লায়লা রকীবের মালিকানায় রয়েছে এই ভবনটি। বাংলাদেশ সরকার এ ভবনটি ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ ২ হাজার ৯০০ টাকা মূল্যে ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

এ প্রাচীন ভবনটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত। বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৯ সালে রোজ গার্ডেনকে সংরক্ষিত ভবন ঘোষণা করে। দেশী-বিদেশি পর্যটকদের কাছে এটি ঢাকার অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান। রোজ গার্ডেন ১৯৭০ থেকে নাটক ও টেলিফিল্ম শুটিং স্পট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।

২২ বিঘা জমির উপর স্থাপিত হয়েছিল রোজ গার্ডেন প্যালেস। ভবনটির মোট আয়তন সাত হাজার বর্গফুট। উচ্চতায় পঁয়তাল্লিশ ফুট। ছয়টি সুদৃঢ় থামের উপর এই প্রাসাদটি স্থাপিত। প্রতিটি থামে লতাপাতার কারুকাজ করা। প্রাসাদটির স্থাপত্যে করিন্থীয়-গ্রিক শৈলী অনুসরণ করা হয়েছে। এছাড়া বাগানটি সুদৃশ্য ফোয়ারা, পাথরের মূর্তি ইত্যাদি দ্বারা সজ্জিত ছিল। মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় পাঁচটি কামরা আর একটি বড় নাচঘর আছে। নিচতলায় আছে আটটি কামরা। রোজ গার্ডেন প্যালেসের পশ্চিম ও উত্তর দিকের দেয়ালের মধ্যবর্তী অংশে দুটি মূল ফটক আছে। প্রবেশ ও বহির্গমনের জন্য স্থাপিত পশ্চিম দিকের ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমেই আছে একটি বিস্তীর্ণ খোলা প্রাঙ্গণ। এখানে মঞ্চের ওপর দণ্ডায়মান নারী মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। পূর্বাংশের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি আয়তকার পুকুর। পুকুরের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের মাঝামাঝি একটি করে বাঁধানো পাকা ঘাট আছে। এর পূর্ব দিকে আছে পশ্চিমমুখী একটি দোতলা ইমারত যার বর্তমান নাম ‘রশিদ মঞ্জিল’। রশিদ মঞ্জিলের প্রবেশপথের সামনের চত্বরে ইট ও সিমেন্ট নির্মিত একটি সুন্দর ফোয়ারা রয়েছে। একটি সাত ধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ি দিয়ে রশিদ মঞ্জিলের প্রথম তলায় যেতে হয়। এর সামনের দিকের মাঝামাঝি অংশের প্রতি কোঠার পাশাপাশি তিনটি খিলান দরজা আছে। 

রোজ-গার্ডেনের ওপরের তলায় প্রতিটি খিলানের ওপর একটি করে পডিয়াম আছে। টিমপেনামগুলো লতাপাতার নকশা এবংবেলজিয়ামে তৈরি রঙিন কাচ দিয়ে শোভিত। এর সামনে আছে বাইরের দিকে উপবৃত্তাকার ঝুল বারান্দা। এর দুপাশে একটি করে করিন্থীয় পিলার আছে। পিলারগুলোর দুই পাশের অংশে প্রতি তলায় আছে একটি করে দরজা। এদের প্রতিটির কাঠের পাল্লার ভ্যানিশিং ব্লাইন্ড ও টিমপেনামে লতাপাতার নকশা দেখা যায় এবং সামনেই অপ্রশস্ত উন্মুক্ত ঝুল বারান্দা রয়েছে।এর ওপরের অংশে কার্নিশ বক্রাকার যা বেলস্ট্রেড নকশা শোভিত। 

মধ্যবর্তী অংশ ছাদের সামনের ভাগে আছে আট কোণা এবং খিলান সম্বলিত বড় আকারের ছত্রী। এর ছাদ রয়েছে অর্ধগোলাকৃতি একটি গম্বুজে। ইমারতটির দুই কোণে দুটি করিন্থীয় পিলার আছে এদের ওপরে দিকেও ছত্রী নকশা আছে। প্রতি তলায় মোট ১৩টি ছোট ও বড় আকারের কোঠা আছে। প্রথম তলায় প্রবেশের পর পশ্চিমাংশের বাম দিকে আছে ওপরের তলায় যাওয়ার জন্য বৃত্তাকার সিঁড়ি।

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠাকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। 

অন্যদিকে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব। উল্লেখ্য, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *