আওয়ামী লীগের পেটে জাপা’র দুর্গ

রাজনৈতিক ট্রাম্প কার্ডের শিকার রংপুরের জাতীয় পার্টি। খোদ আঁতুড় ঘরেই ছন্নছাড়া অবস্থা দলটির। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের অবর্তমানে দৈন্যদশায় পড়েছে জাতীয় পার্টির মূল ভিত। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের সম্পর্কের দূরত্ব ভাবিয়ে তুলছে সমর্থকদের। এছাড়াও সিনিয়র নেতাদের দলীয় কাঠামো উন্নয়নে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থতা, পরামর্শের ভিত্তিতে সংগঠন না চালানো এবং পার্টির মূল দর্শন থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের সরে থাকায় অনেকটা বিলুপ্তির পথে রংপুরের জাতীয় পার্টি।

গেল কয়েকদিন রংপুরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বললে বেরিয়ে আসে নানা অসঙ্গতির তথ্য। নিবেদিত নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু নেতা ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাদের পক্ষে সরব। দলীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের আখের গোছানোয় ব্যস্ত থাকছেন তারা। এটা ক্ষতির মুখে ফেলেছে দলকে। এমনটাই বলছেন জাপা নেতারা।

তাদের কথা-মহাজোটে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টি মূলত এখন আওয়ামী লীগের পেটে ঢুকেছে। বিজ্ঞাপন

দলের উচ্চ পর্যায়ের কিছু নেতাকে হাতে রেখে পুরো দলটাকে মেরুদণ্ডহীন করে তুলেছে। এর ফলে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের ৩২টি আসনের মধ্যে জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র ৭টি। বিএনপি পেয়েছে ১টি আর বাকি সবগুলো আসন আওয়ামী লীগের দখলে। অথচ এই অঞ্চলের ৩২ আসনের মধ্যে ২১টি আসন ছিল জাতীয় পার্টির দখলে।

রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াছির মানবজমিনকে বলেন, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়ে জাতীয় পার্টির অবস্থান খুব ভালো ছিল। বর্তমানে জাতীয় পার্টির আঁতুড় ঘর অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে। আমাদের ঘরে এখন অন্য কেউ বাস করছে। রংপুরে আমাদের যে আসনগুলো ছিল সেগুলো অনেকটা জোর করে দখল করে নেয়া হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনীতি চর্চার পরিবেশ নেই। এখন কেউ খোলামেলা রাজনীতি করতে পারছে না। যদি কখনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, তখন আবার মানুষ রাজনীতি করবে। বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক দলের ঘর আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেবলমাত্র সরকারি দলের ঘরবাড়ি, আসন সব আছে। তারা ছাড়া আর কেউ দেশে রাজনীতি করতে পারছে না। আমরা কেবল সরকারের ঘরে আশ্রিত। সরকার সব রাজনৈতিক দলকে ভয়ের মধ্যে রেখেছে। ন্যায়সঙ্গত কোনো চাওয়া-পাওয়া নিয়েও সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে স্মারকলিপি দেয়া যাবে না। এখানেও যদি ভয় দেখানো হয়, তাহলে আমরা রাজনীতি করবো কীভাবে। এসএম ইয়াছির আরও বলেন, সরকার জাতীয় পার্টির মেরুদণ্ড খুলে অন্য জায়গায় রেখেছে। যখন দরকার পড়ে তখন আবার মেরুদণ্ড লাগিয়ে খাড়া করে, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে মেরুদণ্ড খুলে রাখে। 

এরশাদের মৃত্যুর পর রংপুরের জাতীয় পার্টি কেমন আছে, জানতে চেয়েছিলাম রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম সিদ্দিকীর কাছে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ আমাদের যে জাতীয় পার্টি উপহার দিয়ে গেছেন সেটি কিন্তু সাধারণ মানুষের পার্টি। তার অবর্তমানে এই দলে কিছু অসাধু নেতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তারা দলটাকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছে। বিশেষ করে আমাদের কিছু কেন্দ্রীয় নেতা যারা পার্টির দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের অনেকেরই নির্বাচনে জয় পাওয়া দূরের কথা, জামানতের অস্তিত্ব থাকবে না। এমন কিছু নেতা সব সময় চিন্তা করেন জোটগতভাবে নির্বাচন করে বিনা ভোটে পাস করার। এমন নেতাদের কারণে রংপুরের এখন মাত্র দুটি আসনের এমপি রয়েছে এই দলের। আবারো যদি সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোটগতভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় পার্টি তাহলে সাধারণ জনগণ থেকেও বিচ্ছিন্ন হবে এই দল। 

এরশাদের সময়ের জাতীয় পার্টি আর বর্তমানের জাতীয় পার্টির মধ্যে পার্থক্য কি, জানতে চেয়েছিলাম কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান আবুল মাসুদ চৌধুরী নান্টুর কাছে। তিনি বলেন, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালীন জাতীয় পার্টি আর বর্তমানের জাতীয় পার্টির মধ্যে বহু পার্থক্য দৃশ্যমান। আগের রমরমা পার্টির অবস্থান একেবারেই নেই। এর জন্য আমরা যারা দায়িত্বে আছি তারাই দায়ী। কর্মীরা দায়ী নয়। নেতাদের কারণেই মানুষের মন দিন দিন এই দল থেকে উঠে যাচ্ছে। এর পেছনের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রথমত সিদ্ধান্তহীনতা। নেতারা এক বিষয় নিয়ে আজকে এক কথা, কাল আরেক কথা, এমন কি সকাল-বিকাল তারা কথা পরিবর্তন করেন। ফলে মানুষের বিশ্বাসের জায়গা, আস্থার জায়গা নষ্ট হতে থাকে। বর্তমানে এর প্রভাব চরমভাবে পড়েছে দলটির ওপরে। তবুও তিনি মনে করেন, পার্টির হর্তাকর্তারা যদি নিজেদের সংশোধন করে জনগণের কাছে এখনো ফিরে আসেন, তাহলে রংপুর অঞ্চলের মানুষ তাদের ফিরিয়ে দেবেন না। 

আঁতুড় ঘরে দুরাবস্থা কীভাবে সৃষ্টি হলো? সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলো কি করে রংপুরের জাতীয় পার্টি- এমন বিষয় নিয়ে আলাপ হয় জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার সঙ্গে। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির সহযোগিতা নিয়ে বর্তমান সরকার বারবার ক্ষমতায় এসেছে। তার পরও এই দলকে বিলুপ্ত করার জন্য বর্তমান সরকারের একটি সুপ্ত পরিকল্পনা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বগুড়া হলো বিএনপির ঘাঁটি। ওখানে শত চেষ্টা করেও জাতীয় পার্টির একটি আসনও পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ সেখানে আমাদের আসন দিয়েছে সরকার। রংপুরের ক্রিম আসনগুলো আমাদের না দিয়ে আওয়ামী লীগ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকেই জাতীয় পার্টির দুর্গে হানা দিয়েছে। এ বিষয়টি যদি আমাদের কেন্দ্রীয় নেতারা না বোঝেন তাহলে হয়তো আর কখনোই জাতীয় পার্টি পূর্বের অবস্থানে ফিরে যেতে পারবে না।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *