ঢাকা: ‘হলি আর্টিজান বেকারিতে কলঙ্কজনক এ হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করা হয়েছে। যাতে বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এর ফলে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়।’ এই মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া রায়ে এমন পর্যবেক্ষণই উঠে আসে।
চার বছর আগের এই হামলার ঘটনায় ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে তথাকথিত জিহাদ কায়েম এর লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস এর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশান হলি আর্টিজান বেকারীতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হলি আর্টিজান হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
‘নিরপরাধ দেশি-বিদেশি মানুষ যখন রাতের খাবার খেতে হলি আর্টিজান বেকারিতে যায় তখনই আকস্মিকভাবে তাদের উপর নেমে আসে জঙ্গিবাদের ভয়াল রূপ। জঙ্গি সন্ত্রাসীরা শিশুদের সামনে এ হত্যাকাণ্ড চালায়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য জঙ্গিরা নিথর দেহগুলোকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপরীতে পরিণত হয় হলি আর্টিজান বেকারী।’
অপরদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনার তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো- প্রথমত, কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে শক্তি-সামর্থ্যের বিষয়ে জানান দেওয়া। দ্বিতীয়ত, বিদেশি নাগরিকেদের হত্যা করে নৃশংসতা প্রদর্শন করা এবং তৃতীয়ত, দেশি-বিদেশি সংবাদ প্রচার মাধ্যমে প্রচার করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা।
হামলার প্রেক্ষাপট বিষয়ে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, তামিম চৌধুরী ও সারোয়ার জাহান মানিকের নেতৃত্বে (নব্য জেএমবির প্রধান তামিম চৌধুরী ও সারোয়ার জাহান দুজনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হন) ২০১৫ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্র, মসজিদের ইমাম, সুবিধা বঞ্চিত অসচ্ছল পরিবারের যুবক, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া ছেলে, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায়ের তরুণ ছাত্র নব্য জেএমবিতে সংগৃহীত হয়। তামিম চৌধুরী উন্নত প্রযুক্তির সহযোগিতায় কথিত জিহাদের অপব্যাখ্যা সম্বলিত দৃষ্টিনন্দনও হৃদয়গ্রাহী সাক্ষী ডকুমেন্ট প্রদর্শন করে তরুণদের নব্য জেএমবিতে যোগদান করতে আগ্রহী করে তোলে। তারা বাংলাদেশে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে।
ঘটনার বিবরণী থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির (আত্মঘাতি) সদস্যরা। তাদের গুলিতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। পরে কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়।
ওই ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন ওই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রিপন কুমার দাস। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির মামলাটি তদন্ত করে ২০১৮ সালের ১ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। একই বছরের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান।
এই মামলার বিচার শুরুর সময় ৮ আসামির ৬ জন কারাগারে ছিলেন। বিচার চলাকালে বাকি দুজন গ্রেফতার হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ৬(২)(অ), ৭, ৮, ৯, ১১, ১২ ও ১৩ ধারায় চার্জগঠন করা হয়। মোট ২১১ জন সাক্ষীর ১১৩ জন অত্র আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
এরপর আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন এবং রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে গত ১৭ নভেম্বর এই মামলার বিচারকাজ শেষ হয়। ওইদিনই আদালত রায় ঘোষণার জন্য ২৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেন।
রায়ে মামলার ৮ আসামির ৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ এবং মামুনুর রশিদ রিপন। এছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।