অব্যবহূত থেকেই বিকল কোটি টাকা মূল্যের আধুনিক যন্ত্রপাতি

দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সাধারণ মানুষের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য সরকারি বরাদ্দে এমআরই মেশিনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম কেনা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন অব্যবহূত থাকায় এসব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়েছে। এতে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে রোগীদের।

অভিযোগ রয়েছে, শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল কয়েকজন ব্যক্তির নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব রয়েছে। এ কারণে তারা সচল যন্ত্রপাতি অচল করে মেডিকেলে আসা রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে শুরু করে জটিল অপারেশনের জন্য বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য করছেন। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করে হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, টেকনিশিয়ান নিয়োগ না দিয়েই এসব যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল। এজন্য অব্যবহূত থেকেই সেগুলো নষ্ট হয়েছে।

শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মুমূর্ষু রোগীর জীবন রক্ষায় ২০১৭ সালে ১০টি আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়। কিন্তু সেগুলো দীর্ঘদিন অব্যবহূত থেকে এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। একই অবস্থা আল্ট্রাসনোগ্রামের দুটি মেশিনের ক্ষেত্রেও। দুই বছর ধরে আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন দুটি বিকল রয়েছে। এছাড়া মস্তিষ্কে আঘাত, হাড়ে কিংবা শরীরের মধ্যে জটিল রোগ নির্ণয়ের জন্য কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা এমআরআই মেশিনও দুই বছর ধরে বিকল। ক্যান্সার রোগীর রেডিয়েশন দেয়ার জন্য খুলনা ও বরিশাল বিভাগের একমাত্র কোবাল্ট-৬০ মেশিন রয়েছে শেবাচিম হাসপাতালে। অথচ গত দুই বছর পর্যন্ত অব্যবহূত থেকে সেটিও এখন বিকল। অত্যাধুনিক দুটি সিটিস্ক্যান মেশিনের একটি এক বছর ধরে এবং অন্যটি আট মাস ধরে বিকল রয়েছে।

এদিকে দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে নষ্ট ১০টি আইসিইউ বেড মেরামত করে সচল করা হয়েছে। এছাড়া আরো ১৮টি আইসিইউ বেড হাসপাতালটিতে স্থাপন করা হয়। তবে আইসিইউ ইউনিটের জন্য এখনো পদায়ন করা হয়নি কোনো চিকিৎসক। অন্য বিভাগের চিকিৎসক দিয়ে কোনোমতে চালু রাখা হয়েছে আইসিইউ সেবা।

গুরুত্বপূর্ণ একাধিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বিকল থাকায় রোগ নির্ণয়ে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দাবি, শেবাচিমের আধুনিক ডিজিটাল মেশিন দিয়ে এক্স-রে করা হলে আল্ট্রাসনোগ্রামের প্রয়োজন হয় না। গুরুত্বপূর্ণ কিডনি ও লিভার এক্স-রে করার ব্যবস্থা থাকলেও টেকনিশিয়ানের সংকট দেখিয়ে তা বন্ধ রাখা হয়েছে। ছয়টি এক্স-রে মেশিনের মধ্যে চারটি অচল থাকায় দুটি মেশিন দিয়ে এক্স-রে করাতে রোগীদের দীর্ঘলাইনে অপেক্ষা করতে হয়। ফলে হয়রানি আর টেকনোলজিস্টদের রুক্ষ ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সেবাপ্রত্যাশীরা চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন নগরীর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয়।

সূত্রটি জানায়, রি-এজেন্ট সংকটের অজুহাতে দীর্ঘদিন থেকে শেবাচিমের প্যাথলজিতে হরমোন, অ্যালার্জি ও যৌন রোগের পরীক্ষা হয় না। অথচ রি-এজেন্ট সংগ্রহের উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের। এছাড়া প্যাথলজি বিভাগেও জনবল সংকট রয়েছে। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাক্সবন্দি অবস্থায় পড়ে থাকার পর ২০১৮ সালে হূদরোগীদের সেবার জন্য চালু করা হয় এনজিওগ্রাম মেশিন। অথচ গত ছয় মাসেরও অধিক সময় ধরে এনজিওগ্রাম মেশিনের কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালের ইটিটি মেশিনটিও এক বছর ধরে বিকল। এছাড়া চক্ষু রোগীদের সেবায় ২০১৫ সালে ১২ কোটি টাকায় কেনা লেসিক মেশিনটি এক বছর ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে। চোখের ছানি অপারেশনের ফেকো মেশিনটিও চার বছর ধরে বিকল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেবাচিম হাসপাতালের সামনের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক বলেন, হাসপাতালের যেকোনো রোগীকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে এলে পরীক্ষা ফির ৩০ ভাগ আয়া-বুয়া এবং ৩০ ভাগ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে কমিশন হিসেবে দিতে হয়।

ভারী যন্ত্রপাতিগুলো বিকল থাকার কথা স্বীকার করলেও কৃত্রিমভাবে (রহস্যজনক) যন্ত্রপাতিগুলো বিকল করে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেন শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. বাকির হোসেন।

তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ভারী ভারী মেশিন ক্রয় করা হয়। এতে এক শ্রেণীর মানুষের (ঠিকাদার) ব্যবসা হয়। অথচ এগুলো চালানোর জন্য হাসপাতালে দক্ষ ও যোগ্য জনবল নেই। এসব আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য হাসপাতালে কমপক্ষে দুজন বায়োমেডিকেল প্রকৌশলীর প্রয়োজন। কিন্তু শুরু থেকে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে বায়োমেডিকেল প্রকৌশলীর কোনো পদই সৃষ্টি হয়নি।

তিনি বলেন, অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী এ হাসপাতালে ২২৪ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৯৬ জন। এছাড়া প্রয়োজনীয় টেকনোলজিস্টেরও সংকট রয়েছে। ফলে সবকিছু সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *