৩৫ বছর ধরে নিজ গ্রামেই মাছ ধরে জীবিকা উপার্জন করে আসছিলেন জেনেট ক্লেটাস। দক্ষিণ ভারতের কেরালা উপকূলের এ নারী এবং তার সহকর্মী অন্যান্য নারী মৎস্যজীবীর জন্য বর্তমানের মতো কঠিন সময় আগে কখনো আসেনি।
কভিড-১৯-এ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ভারত। বেশির ভাগ লকডাউন বিধিনিষেধ শিথিল করা হলেও অনানুষ্ঠানিক বিক্রেতাদের ওপর কিছুটা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এবং অনেক গ্রাহক কেনাকাটা করতে বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছেন।
থিরুভানাথাপুরাম জেলার ভালিয়া ভেলির বাসিন্দা ক্লেটাস বলেন, প্রথমে আমাদের ঘরের পুরুষরা মাছ ধরতে যেতে পারত না। যখন তারা মাছ ধরে এনেছে তখন আমাদের আবার কিনতে দেয়া হয়নি। এখন আমরা যদি তা কিনে থাকি তা আমাদের গ্রামের বাইরে বিক্রি করতে পারি না।
মহামারী নিয়ন্ত্রণে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তাদের গলা টিপে ধরছে বলে জানান ৬০ বছর বয়সী এ নারী।
ক্লেটাস আরো বলেন, সরকার চায় বাজারে প্রবেশের আগে আমরা যেন কভিড-১৯ পরীক্ষা করি, স্বাস্থ্য সার্টিফিকেট ও পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নিই। পরীক্ষাটি ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও আমাদের করতে হচ্ছে। কারণ তা না হলে আমরা না খেয়ে মারা যাব।
ভারতের সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটারের উপকূলে মাছ ব্যবসায় সম্পৃক্ত হাজারো নারীর একজন হলেন ক্লেটাস। উদ্বিগ্ন ক্রেতা, অনলাইন বিক্রি, চলাচল ও বাজারে প্রবেশে অব্যাহত বিধিনিষেধ আরোপে জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে তারা।
সরকারি তথ্য বলছে, ভারতের আনুমানিক ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ মাছ ধরা এবং সম্পর্কিত কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। তামিলনাড়ু রাজ্যের পোম্পুহারের ফিশ ফর অল গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান এস ভেলভিজি বলেন, মাছ ধরা, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণনে প্রায় অর্ধেক শ্রমশক্তির প্রতিনিধিত্ব করেন নারীরা।
ঐতিহ্যগতভাবে, হেডলোডার হিসেবে পরিচিত নারীরা বাঁশের ঝুড়িতে বা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে সার্ডিন, চিংড়ি এবং অন্যান্য মাছ বহন করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করেন। কেউ কেউ ফুটপাতে বসে বা মাছের বাজারের বাইরে বসে বিক্রি করেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই স্বামীহীন এবং তাদের উপার্জনের ওপর পরিবারের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটে। মহামারীটি ওই নারীদের ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তাদের পরিবারকে দারিদ্র্যের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
লকডাউনের মধ্যেই দেশটির মৎস্য শিল্পকে আধুনিকীকরণের বিস্তৃত পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল ভারত সরকার। ভারতের মৎস্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম কমিশনার শঙ্কর লক্ষ্মণ টমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেন, নতুন পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে মৎস্যজীবী নারীদের ক্ষমতায়ন করা। আমরা জানি যে মহামারীটি নারী মৎস্যজীবীদের খারাপভাবে আঘাত করেছে। নতুন প্রকল্প তাদের উপকৃত করবে। আমরা আর রাস্তার পাশে বিক্রেতাদের উৎসাহ দিচ্ছি না এবং ফ্রিজারের সঙ্গে আধুনিক কিওস্ক স্থাপন ও স্বাস্থ্যকরভাবে বিক্রির ক্যাবিনেট স্থাপনে সহায়তা করছি।
অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যের ট্র্যাডিশনাল ফিশ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি লক্ষ্মী কাউয়াদা বলেন, তিনি সরকারের পরিকল্পনায় মুগ্ধ নন। ২০ বছর ধরে এ ব্যবসায় থাকা কাউয়াদা মাছ বিক্রেতাদের তাত্ক্ষণিক আর্থিক সহায়তার দাবি জানিয়ে বলেন, আজকের প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে নারীরা মাছ বিক্রির জন্য অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক বা আবাসন কলোনিগুলোতে প্রবেশ করতে পারছেন না।
মাস্ক পরে ও হাত ধোয়ার অতিরিক্ত পানি বহন করে কয়েক সপ্তাহ আগে তামিলনাড়ু রাজ্যের মায়িলাদুুথুরাই শহরের একটি রাস্তার কোণে মাছ বিক্রি করতে গিয়েছিলেন মহারানী সেলভামনি নামের এক নারী মৎস্যজীবী। তিনি বলেন, আমি বিক্রি করতে মাত্র ২ হাজার রুপির মাছ কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মাত্র ৫০০ রুপির মাছ বিক্রি করতে পেরেছি। আমি কখনো এ ধরনের লোকসানের মুখোমুখি হইনি। লকডাউনে স্বামী হারানো এ নারী আরো বলেন, যেখানেই যাই পুলিশ ও পৌর কর্মীরা আমাদের তাড়িয়ে দেয়।
গত সপ্তাহে তিনি তার নিয়মিত গ্রাহকদের নম্বর নিজের মোবাইল ফোনে সংরক্ষণ করতে শুরু করেছেন এবং তাদের নিজের নম্বর দিচ্ছেন। তিনি বলেন, মাঝে মাঝে আমি তাদের ফোন করে আমার কাছে থাকা মাছ এবং আমি কোথায় আছি তা জানাই। তবে এ চেষ্টা যে যথেষ্ট ফল বয়ে আনছে, সে ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী নন ওই নারী। রয়টার্স অবলম্বনে