করোনাকালে সুপারকার ও বিলাসে মগ্ন ব্যাংককের বিত্তশালীরা

মহামারী নভেল করোনাভাইরাস বৈশ্বিক অর্থনীতিকে স্থবির করে দিলেও তা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নন থাই ব্যবসায়ী ইয়োড। চলমান এ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেই তিনি ঠিক করেন, নিজেকে নিজে উপহার দেবেন ৮ লাখ ৭২ হাজার ডলারের একটি সুপার কার। আর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাংককে বসে ঠিকই কিনে ফেলেন একটি লাইম গ্রিন কাস্টমাইজড ল্যাম্বরঘিনি হুরাকান ইভো। মূলত ইয়োডের মতো হংকংয়ের বিলিয়নেয়ারদের জীবনযাপনের দিকে তাকালে বিশ্ব যে একটি মূর্তিমান সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা বোঝা দুষ্কর।

চীনভিত্তিক হুরুন প্রতিবেদনের ২০২০ সালের বৈশ্বিক ধনকুবেরদের তালিকা অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বিলিয়নেয়ারের আবাসস্থল হিসেবে থাইল্যান্ড রয়েছে নবম স্থানে। এসব ধনকুবেরের অন্যতম ইয়োড, যার পুরো নাম থানাকোর্ন মাহানোনথারিত। ল্যাম্বরঘিনি ক্রয়ের বিষয়ে ব্যাংককভিত্তিক এই অমায়িক পেট্রো-কেমিক্যাল ব্যবসায়ী বলেন, গাড়িটি আমাকে ডেভিড বেকহামের মতো অনুভূতি দেয়। যখন এর দরজা খুলে বের হবেন, তখন সবাই এমনভাবে তাকাবে যেন আপনি একজন মহাতারকা।

ইয়োড আরো বলেন, এ সুপারকার ক্রয়ের মধ্য দিয়ে আমার বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এটি আমার সফলতার প্রতিচ্ছবিও বলা যেতে পারে। তবে এর মানে এই নয় যে আমি আপনার থেকে বেশি যোগ্য। আমি শুধু স্বপ্ন সত্যি করতে যথেষ্ট খেটেছি মাত্র।

মূলত মহামারীর মধ্যেই ব্যাংককের বাজারে শীর্ষ মডেলের বিভিন্ন গাড়ি নিয়ে এসেছে ল্যাম্বরঘিনির পাশাপাশি ফেরারি ও রোলস রয়েসের মতো বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলো। এসব গাড়ির দাম সাড়ে ৭ লাখ থেকে ১২ লাখ ডলার পর্যন্ত। বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংককে ছড়িয়ে থাকা বিপুল সম্পদের ওপর টোপ ফেলতেই যেন গাড়িগুলো বাজারে আনা হয়েছে। আর গত সপ্তাহেই লাখ লাখ ডলার মূল্যের এ গাড়ির মালিকদের এক গর্বিত প্রদর্শনীরও দেখা মেলে রাজধানীতে। শহরের মধ্য দিয়ে সদর্পে এগিয়ে যায় থাইল্যান্ড ল্যাম্বরঘিনি ক্লাবের ৪০টি গাড়ির আকর্ষণীয় এক বহর।

অটোমোবিলি ল্যাম্বরঘিনির এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান নির্বাহী মাত্তেও ওর্তেনজি বলেন, ল্যাম্বরঘিনি মূলত উচ্চসম্পদশালী নির্দিষ্ট একটি শ্রেণীকে আকৃষ্ট করে। থাইল্যান্ডে আমাদের গাড়ির প্রতি আগ্রহ ও চাহিদা দুই-ই অব্যাহত আছে। সত্যি বলতে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ড হলো আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজার।

তবে বাস্তবতা হলো, এশিয়ার সবচেয়ে বৈষম্যপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম থাইল্যান্ড। দেশটি পরিচালিত হচ্ছে অতিধনী রাজতন্ত্র ও কিছু পরিবারের মাধ্যমে। বিভিন্ন ব্যবসায় চলছে তাদের একচ্ছত্র মনোপলি। বিশেষ করে ছয় বছর সেনা সমর্থিত সরকারের সময় তাদের অর্থভাগ্য ফুলে-ফেঁপে ওঠে। বৃহত্তর অর্থনীতি পিছিয়ে পড়লেও তাদের হাতে আসতে থাকে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক চুক্তি। এ বিষয়ে ব্যাংককের চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক থিতিনান পোংসুধিরাক বলেন, মাত্র ১ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কাছে দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ রয়েছে। এ বৈষম্য নিশ্চিতভাবেই থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক সংকট ত্বরান্বিত করছে।

এদিকে ধনীরা যখন দামি গাড়ি হাঁকাচ্ছেন, তখন দেশটির বহু মানুষ নিজেদের আরো বেশি করে সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত দেখতে পাচ্ছেন। চাহিদার পতনে ধুঁকছেন কৃষকরা। কমে গেছে রেমিট্যান্সপ্রবাহ। অন্যদিকে নগদ অর্থের সংকটে ভুগছে শহুরে মধ্যবিত্তরা। তারা ঋণ ও এমনকি বিদ্যালয়ের ফিও দিতে পারছে না। এ অবস্থায় চলতি বছরের শেষ নাগাদ দেশটির পারিবারিক ঋণ বেড়ে জিডিপির ৮৮-৯০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাছাড়া সরকারি উপাত্ত অনুযায়ী, মহামারীর কারণে চাকরি হারাতে পারে থাইল্যান্ডের ৮৪ লাখ মানুষ। এমন হলে গত দুই দশকে দারিদ্র্য বিমোচনে থাইল্যান্ডের যে উন্নতি হয়েছে, তা ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমনকি মার্চে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহামারী আঘাত হানার আগেই দেশটিতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ বৃদ্ধি পেয়ে ৬৭ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে।

থাম্মাসাট বিজনেস স্কুলের শিক্ষক পাভিদা পানানোন্দ বলেন, মহামারী পুরো দেশের অর্থনীতিকে অভাবনীয় সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মধ্যবিত্ত ও শ্রমিকশ্রেণীর জন্য যথাযথ কোনো অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু ধনিক শ্রেণী ঠিকই বিশেষ মাত্রায় অর্থনৈতিক সুরক্ষা উপভোগ করে চলেছে। আর এ আর্থিক সুরক্ষার চিহ্নের দেখা মিলবে পুরো ব্যাংককে। যেমন রিয়েল এস্টেস এজেন্সি সিবিআরই থাইল্যান্ডের তথ্য অনুযায়ী, যেসব বাড়ির দাম ১০-৫০ লাখ ডলার সেগুলোর বিক্রি বেশ ভালোই হচ্ছে। থেমে নেই সৈকতে সম্পদশালীদের ইয়োগা সেশন, সমুদ্রে ইয়ট কিংবা শ্যাম্পেইন পার্টি।

এ বিষয়ে ফ্যাশন ও সোসাইটি ম্যাগাজিন টাটলার থাইল্যান্ডের প্রধান সম্পাদক নাফালাই আরিসর্ন বলেন, সত্যি বলতে তাদের টাকা আছে এবং তারা যেকোনো সময় তা খরচ করতে পারে। আর উপায় থাকুক কিংবা না থাকুক ব্যাংককে এ সম্পদশালী উচ্চসমাজে প্রবেশ ও সেখানে অবস্থানের আকাঙ্ক্ষা কিন্তু বহু মানুষেরই রয়েছে।

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *