সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন: ‘ডানঘেঁষা পরিচয়’ মুছতে চায় বিএনপি

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের মধ্য দিয়েই দলীয় রাজনীতির মোড় ঘোরাতে চায় বিএনপি। জনমনে দলটি স্পষ্ট করতে চায় যে বিএনপি প্রকৃত পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ তথা উদারপন্থী একটি রাজনৈতিক দল। পাশাপাশি বিএনপিকে জড়িয়ে জনমনে ‘অপপ্রচার’ দূর করে জামায়াতকে ছাড়ার চাপ সৃষ্টির জন্য এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায় তারা।

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে বিএনপির নতুন এই অবস্থানের কথা জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নেতারা বলেন, দলের পরিচয়বিভ্রাট দূর করা তথা জামায়াতকে জড়িয়ে ‘ব্র্যাকেটবন্দি’ অবস্থা থেকে তারা বিএনপিকে মুক্ত করতে চাইছেন।

‘বিএনপি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল’ এমন প্রচারণা শুরু হয় ১৯৯৯ সালে জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে জোট বাঁধার পর থেকে। ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ওই জোট গঠনের কারণে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়েও দেশে-বিদেশেও বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ওই ধরনের প্রচারণার ফলে মধ্যপন্থী অবস্থান থেকে বিএনপিকে আস্তে আস্তে ডানপন্থী বা দক্ষিণপন্থী অবস্থানের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আর এ কারণেই আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন হারিয়েছে দলটি। সূত্র মতে, বিএনপি এখন ওই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
পুলিশের ওপর হামলা,হত্যা মামলার আসামি ছিনতাই ≣ তুষার আবদুল্লাহ : চাই হতে তারুণ্যের শেরপা ≣ [১] দীর্ঘ ১৮ দিন করোনার সাথে যুদ্ধ করে ছেলেসহ করোনা জয় করলেন সাংবাদিক জেহাদুল

তবে বিএনপি বরাবরই অভিযোগ করে আসছে, মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলছে আওয়ামী লীগ। অথচ প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে অজস্র মুক্তিযোদ্ধা দলে নিয়েও বিএনপি কেন মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের অর্জনের খাতায় তুলতে পারল না এমন প্রশ্ন ইদানীং ঘুরে-ফিরে উঠতে শুরু করেছে। সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের এটাই অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে।

যদিও ৭ই মার্চ উদযাপন নিয়ে বিএনপির ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। দলের একটি অংশ মনে করছে, স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান যেখানে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি অস্বীকার করছে, সেখানে ৭ই মার্চ পালনের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু দলের উদারপন্থী বলে পরিচিত অংশটি আবার স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি বিএনপিকেও ওই ধারায় ব্র্যান্ডিংয়ের পক্ষে।

দিবসটি উপলক্ষে দেওয়া বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘৭ই মার্চে যে ভাষণ শেখ মুজিবুর রহমানের সেটি অবশ্যই ইতিহাস। অবশ্যই তাঁর মর্যাদা তাঁকে দিতে হবে। কাউকে খাটো করার কোনো রকম ইচ্ছা আমাদের নেই এবং আমরা বিশ্বাস করি সেটা উচিতও হবে না। বিশেষ করে স্বাধীনতার ব্যাপারে প্রকৃত সত্য সবাইকে উদঘাটন করতে হবে।’

সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সুবর্ণ জয়ন্তীর বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট নেতাদের ধন্যবাদ জানান। তিনি সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্য খণ্ডন করে সুবর্ণ জয়ন্তীর কর্মসূচিতে বিএনপি নেতাদের দেওয়া বক্তব্য ভিডিও ও বুকলেট আকারে জনগণের মধ্যে প্রচার করার নির্দেশনা দেন। এ ছাড়া দলের নেতাকর্মীদের এসব ইতিহাস জানাতে দলের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পুনরায় চালু করতে বলেন।

সূত্র জানায়, ৭ই মার্চসহ সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠান নিয়ে দলের ক্ষুদ্র একটি অংশের নেতিবাচক তৎপরতা এত দিন থাকলেও ওই দিন তারেক রহমানের বক্তৃতার পর তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তারেক রহমান দলের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অংশকে সমর্থন করে ওই দিন বক্তব্য দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থায়ী কমিটির অন্তত চারজন নেতা জানান, ‘সুবর্ণ জয়ন্তীর এই পথ ধরেই জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার চাপ সৃষ্টি করতে চান তাঁরা।’ তাঁদের মতে, ‘এখানে গোঁজামিল দেওয়ার আর সুযোগ নেই।’ বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে কয়েকজন নেতার আলোচনা হয়েছে বলে ওই দুই নেতা দাবি করেন। তাঁরা বলেন, মনে হচ্ছে আগের তুলনায় তাঁরা (খালেদা-তারেক) কিছুটা নমনীয়।

জানতে চাইলে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘দেশের জনগণ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে চাই। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি ও সঠিক তথ্য উপস্থাপনই সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের উদ্দেশ্য। এখানে কাউকে ছোট, কাউকে বড় করা নয়; যাঁর যেটুকু প্রাপ্য তাঁকে সেই মর্যাদা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই বিএনপি সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।’ ‘বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের মাধ্যমে। এই দল মুক্তিযোদ্ধার দল’—বলেন লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও গেজেটভুক্ত এই মুক্তিযোদ্ধা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি চরম ডানপন্থার বামে এবং বামপন্থার ডানে উদারপন্থী একটি দল। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি দল। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা লড়াই করছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে জড়িয়ে চরমপন্থার নানা তত্ত্ব প্রকাশ করা হয় মূলত রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য। ভবিষ্যতে বিএনপি তাদের এই সুযোগ দেবে না।’

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু মনে করেন, ‘বিএনপি বামপন্থীও নয় ডানপন্থীও নয়; বিএনপি মুক্তচিন্তার উদারপন্থী একটি দল। মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েই বিএনপি সংগঠিত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সুবর্ণ জয়ন্তী আমরা পালন করছি সত্যিকার ইতিহাস তুলে ধরার জন্য। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের পর রাজনৈতিকভাবে সমাধানের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করার জন্য জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। জিয়ার প্রবর্তিত রাজনীতির পথেই বিএনপি হাঁটছে।’

0Shares

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *